Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

আমার তো দেশই নেই, তাই পুজোও নেই

অসমের রিহাবাড়ি থেকে তাঁর বোন রুবি সেনগুপ্ত ফোনে বললেন, “যাঁর কোনও ঠিকানা নেই, তাঁর নিজের কোনও পুজোও নেই।”   

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

অনির্বাণ রায়
জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৪:৪০
Share: Save:

কথার মাঝে হঠাৎ চুপ করলেন। ছোট্ট ঘরটায় তখন শুধু সিলিং ফ্যানের শব্দ। খানিক থেমে কথা শুরু করলেন, “শুনলাম, এ বার ওদের ট্রাইবুন্যালে যেতে হবে। অনেক খরচ।”

পকেট থেকে ছোট একটা মোবাইল বের করে ফোন করলেন। ফোনে যাঁকে খুঁজলেন, তাঁকে পেলেন না। কান থেকে ফোন নামিয়ে বললেন, “বাজার গিয়েছে। ওর বর এখন চোখে দেখতে পায় না। ওকেই সব কাজ করতে হয়। তার মধ্যে এই হ্যাপা। আমার বোন এখন সব সময়ে আতঙ্কে ভোগে, যদি দেশ থেকে বের করে দেয়!” সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা সত্তর পেরোনো ‘দাদা’ এ বার চোখ সরিয়ে নিলেন। ডান দিকে মুখ তুলে চেয়ে রইলেন বাইরের দিকে। বাইরে নীল আকাশে তখন ছেঁড়া মেঘ। দু’একটা কাশফুল উড়ছে বাতাসে। উমার বাপের বাড়ি আসার আর বেশি দেরি নেই।

আরও কিছু সময় পেরিয়ে যায়। বোন বাজার সেরে ফিরে আসেন। নম্বর দেখে দাদাকে ফোন করেন। নাগরিক পঞ্জিতে নাম তুলতে গেলে আরও কী কাগজ প্রয়োজন হবে, কোনও আদালতে মামলা হবে সেগুলি নিয়ে ফের কথা হয়। কথার মাঝে মাঝে নীরবতাই বেশি। একরাশ চিন্তা, উদ্বেগ জড়ো হয়ে তৈরি নীরবতা। মোবাইল তরঙ্গে নীরবতা ছুটে বেড়ায় জলপাইগুড়ির আশ্রম পাড়া থেকে অসমের রিহাবাড়িতে। দুর্গাপুজো নিয়ে কোনও কথা হয় না ভাই-বোনের। অথচ একসময়ে পাড়ার মাঠে মণ্ডপ বাঁধার বাঁশ পড়লেই ভাই-বোনের কথায় পুজো ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ই থাকত না। জলপাইগুড়ির বাড়িতে বসে ‘দাদা’ মনোজিত সাহা বলেন, “আমরা এক সঙ্গে বাঁশে উঠতে যেতাম। কোথায় কোন পুজোর কী আয়োজন হচ্ছে, সেগুলো জেনে বোনকে বলতাম। আর বোনের প্রশ্ন যেন শেষই হত না।”

অসমের রিহাবাড়ি থেকে তাঁর বোন রুবি সেনগুপ্ত ফোনে বললেন, “যাঁর কোনও ঠিকানা নেই, তাঁর নিজের কোনও পুজোও নেই।”

অসমের নাগরিক তালিকায় রুবির নাম নেই। নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই বিয়ের পর থেকে অসমের বাসিন্দা। নাগরিক তালিকায় নাম তুলতে জলপাইগুড়িতে বাবার নামে থাকা জমির দলিলও জমা দিয়েছিলেন। তবু নাম ওঠেনি। ফোনে রুবি বলতে থাকেন, “বিয়ের পর প্রথম দিকে প্রতিবার পুজোয় জলবপাইগুড়ি যেতাম। তিন বছর আগেও গিয়েছি। এখন যাওয়া হয় না ঠিকই। কিন্তু যাওয়া হোক বা না হোক পুজো এলেই বাড়ি যাওয়ার পরিকল্পনা করি প্রতিবারই। এবার করিনি।” নীরবতা নেমে আসে আবার।

মনে পড়ে যায়, সেই ছোটবেলায় বাবা বলতেন, এই যে শরতে কাশফুলে ভরে যায় নদীর চর, এই যে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভাসে, এই হল দেশের গন্ধ। এই আমাদের উৎসব। এই আমাদের বাড়ি।

রাষ্ট্রের তালিকায় স্বামীর ঘর কিংবা বাপের বাড়ি দুই থেকেই দূরে ঠেলে দিয়েছে তাঁকে। ফোনে বলেন, “কোন বাড়িতে আছি, আর কোন বাড়িতে যাব? আমার তো দেশই নেই। তাই বাড়ি ফেরাও নেই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Assam Assam NRC Jalpaiguri Durga Puja 2019
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE