২০১৭ সালে এ ভাবেই আগুন ধরেছিল পাহাড়ে। ফাইল চিত্র
অনির্দিষ্টকালের জন্য পাহাড় বন্ধের ডাক দিয়েছেন বিমল গুরুং। ঝাঁপ পড়তে শুরু করেছে দোকান, বাজার, হোটেলের। কয়েক দিন ধরেই উত্তাপ বাড়ছিল। এ বারে তাকে চুড়োয় নিয়ে গেলেন বিমল, সেই সময় পাহাড়ের অবিসংবাদী নেতা। তারিখটা ছিল ২০১৭ সালের ১০ জুন।
পাহাড় তখন পর্যটক বোঝাই। দার্জিলিং, কালিম্পংয়ের মতো শহরে কোথাও পা রাখার জায়গা নেই। ছোটখাট পর্যটন কেন্দ্রগুলিতেও নেই তিল ধারণের জায়গা। মরসুমের প্রথম থেকেই পর্যটন ব্যবসায়ীরা খুশি ছিলেন। তাঁদের কথায়, এত ভাল মরসুম সচরাচর দেখা যায় না। বাগডোগরা বিমানবন্দরও সে বারে যাত্রী যাতায়াতে রেকর্ড করে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন বিমল ডাক দিলেন অনির্দিষ্টকাল বন্ধের।
যেখানে হাজার হাজার পর্যটক রয়েছেন পাহাড়ে, সেই সময়ে কেন তিনি এমন বন্ধের ডাক দিয়েছিলেন? সেই সময়ে নানা বিবৃতিতে বিমল এর জবাবে বারবার আঙুল তুলেছিলেন রাজ্য প্রশাসনের দিকে।
সত্যিই কি তাই? এর আগের ঘটনাবলী যদি দেখা যায়, তা হলে ছবি কিছুটা স্পষ্ট হতে পারে। এর ঠিক কয়েক দিন আগে পাহাড়ে পুরভোট হয়। সেখানে বহু দিন পরে প্রথমবারের জন্য পাহাড়ের দল বলে পরিচিত নয়, এমন একটি দল একটি পুরসভা জিতে নেয়। ৫ জুন মিরিক পুরসভার সেই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার আগেই রাজ্য প্রশাসন গোটা রাজ্যে বাংলা ভাষাকে আবশ্যিক করতে চেয়ে নিজেদের ইচ্ছের কথা জানায়। পাহাড়ে জমি হারানোর ভয়ে ভাষা নিয়ে আন্দোলনে দিশা খুঁজতে শুরু করেন বিমল। মিরিক পুরসভার অনুষ্ঠানে এসে মুখ্যমন্ত্রী জানান, পাহাড়ে বাংলা ঐচ্ছিক ভাষা হিসেবে থাকছে। কেউ ইচ্ছে করলে পড়তে পারে, ইচ্ছে করলে না-ও পড়তে পারে।
ততক্ষণে কিন্তু বিমলের আর পিছনোর উপায় নেই। পিছোতে তিনি চানওনি। দু’দিন বাদে দার্জিলিংয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠক। সেই দার্জিলিং, যা বিমলের খাসতালুক এবং যেখানে সে বারে একটি ওয়ার্ডে জিতেছে তৃণমূল। মন্ত্রিসভার বৈঠকের দিন বেনজির অশান্তি দেখল পাহাড়। সেদিন বিমল, বিনয় তামাংদের সঙ্গে মধ্যস্থতায় পৌঁছতে না পারলে মন্ত্রীদের নীচে নামানো কঠিন হয়ে পড়ত। দু’দিনের মধ্যে অনির্দিষ্টকালের বন্ধের ডাক।
সেই অশান্তি পার হয়েও দার্জিলিং পাহাড়ে নতুন সূর্যোদয় হয়েছিল। তবে কয়েকটি প্রশ্ন রেখে গিয়েছে গুরুং জমানা। প্রথমত, ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত পাহাড়ে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল বিমলের। এর মধ্যে জিটিএ গঠন করা হয়। পুলিশ ছাড়া যাবতীয় দায়িত্ব ছিল বিমলদের হাতে। তা হলে যে উন্নয়ন হওয়া দরকার, সেটা হল না কেন? বিমলদের যুক্তি ছিল, রাজ্য প্রয়োজনীয় টাকা দেয়নি। রাজ্যের যুক্তি, টাকা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু বিমলরা তা নয়ছয় করেছেন। বস্তুত, ২০১৭ সালে রাজ্য সরকার যখন জিটিএ-তে বিশেষ অডিট দল পাঠায়, দু’পক্ষের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধ শুরু হয় সেখান থেকেই। দ্বিতীয়ত, উন্নয়নের খামতি ঢাকতেই কি বিমল বারবার পৃথক রাজ্যের দাবি তুলেছেন? ২০১৭ সালের আন্দোলনকেও শেষ অবধি সেই দিকেই ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তৃতীয়ত, তিন বছর ধরে বিমল পাহাড় ছাড়া। তার পরেও তাঁর প্রতি সহানুভূতি রয়েছে পাহাড়ের মানুষের। বর্তমান রাজ্য সরকারের প্রতি ক্ষোভও রয়েছে একই সঙ্গে। যে দুই অস্ত্র কাজে লাগিয়ে গত বছর লোকসভা ভোটে পাহাড়ে বড় জয় পেয়েছেন বিজেপি, বিমল ও জিএনএলএফের যৌথ প্রার্থী রাজু বিস্তা। এখন প্রশ্ন, এই জয়ের কারিগর যে পাহাড়বাসী, তাঁরা কি এখনও পাহাড়ে নতুন করে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন চান? চতুর্থত, রক্তক্ষয়ী আন্দোলন যদি আটকাতে হয়, তা হলে সেটা কী ভাবে, কোন সমাধান সূত্রে?
বিজেপি যদি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান চায় পাহাড়ে, তা হলে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিত এবং এই প্রশ্নগুলি মাথায় রাখতে হবে তাদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy