এক সময়ে কংগ্রেসের ‘দুর্গ’ বলে পরিচিত ছিল উত্তরবঙ্গ। এ বার পুরভোট কিন্তু সেই কংগ্রেসের কাছেই অস্তিত্ব বাঁচানোর লড়াই। দলের একাধিক নেতা-কর্মীই এ কথা মনে করছেন।
তিন দশক পর রাজ্যে তৃণমূলের হাত ধরে ক্ষমতায় আসলেও চার বছরের মাথায় কংগ্রেস এখন বিধানসভায় বিরোধী আসনে। কেন্দ্রের মোদী ঝড়ে গত বছর দিল্লির গদিও দলের হাত ছাড়া। আবার জেলায় জেলায় পুরসভা, পঞ্চায়েত থেকে দলের নেতা-কর্মীদের শাসক দলে নাম লেখানোর হিড়িকও রয়েছে। তাই ‘বেসমাল’ দলে যে ক’জন কর্মী টিকে রয়েছেন, তাঁরাই একজোট করে ‘মরণ-বাঁচন’ লড়াইয়ে নেমেছেন।
উত্তরের পুরভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার পর প্রথমে সর্বত্র প্রার্থী মিলবে কি না, সেই নিয়ে জেলা কংগ্রেস নেতাদের ঘাম ছুটেছিল। শেষ অবধি বেশিরভাগ জায়গাতেই প্রার্থী দেওয়া গিয়েছে। কংগ্রেসের অনেকেই বলছেন, ‘‘বিরোধীদের প্রচার ছিল, কংগ্রেস দল না কি সাইনবোর্ডে পরিণত হয়ে যাবে। সেখানে প্রথম রাউন্ডে প্রার্থী বাছাই-এ দল পাশ করে গিয়েছে, এবার ভোটযুদ্ধের দ্বিতীয় রাউন্ডে পাড়ায় পাড়ায় অস্তিত্ব প্রমাণের অপেক্ষা।’’ তাই পুরভোটের প্রচারে এসে শিলিগুড়িতে প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা বিধায়ক মানস ভুঁইয়া বলেছেন, ‘‘কংগ্রেস এমন একটা দল যার অতীত ছিল, বর্তমান আছে, ভবিষৎ রয়েছে। এবারের ভোটে সেটাই জোরাল ভাবে প্রমাণ হবে।’’
উত্তরবঙ্গের একমাত্র কর্পোরেশন শিলিগুড়ি পুরসভা। তৃণমূল এবং বামেদের সঙ্গে ‘টানাপড়েনে’র পর প্রায় চার বছর ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। শেষে রাজ্যের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ তুলে নিজেই বোর্ড ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে দল। এবার ফের বোর্ড কংগ্রেসের হাতে আসবে তা জেলা কংগ্রেসেরই বেশিরভাগ নেতা মনে করেন না। তবে জোর গলায় তাঁরা দাবি করেছেন, কংগ্রেস প্রার্থীরা একাধিক ওয়ার্ডে জিতবেন এবং বেশ কিছু ওয়ার্ডে বিরোধীদের কঠিন লড়াইয়ের মুখে ফেলবেন। দার্জিলিং জেলা কংগ্রেস সভাপতি (সমতল) তথা বিধায়ক শঙ্কর মালাকারের কথায়, ‘‘আমরা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কর্মীদের সুসংহত করে ভাল প্রার্থী বাছাই করে যে ভাবে ময়দানে নেমেছি, তাতে কংগ্রেস যে শিলিগুড়িতে একটা ফ্যাক্টর তা প্রমাণ হবেই। প্রচারেও আমরা ভাল সাড়া পাচ্ছি।’’
দলের নেতাদের দাবি, এবার শিলিগুড়ি পুরসভার ৭, ১২, ১৪, ১৬, ২১, ২২, ২৫, ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডে কংগ্রেস জেতার মতো অবস্থায় রয়েছে। পাশাপাশি, ৪, ৫ নম্বর ওয়ার্ডে দল জোর লড়াই করছে। আবার ৬, ২৭, ৩২ এবং ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডে হারজিতে কংগ্রেস ‘ফ্যাক্টর’ হবেই। জেলা কংগ্রেসের কয়েকজন নেতা জানান, বাম এবং তৃণমূল শিবির থেকে বারবার দাবি করা হচ্ছিল, ভোটের লড়াই না কী শুধু তাঁদের মধ্যেই হচ্ছে। বাকিদের অস্তিত্বই নেই। কিন্তু ভোটের দিন যতই এগিয়ে এসেছে, ততই তা বলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দলের কর্মীরা নিজেদের সাধ্য মতো একজোট হয়ে লড়ছেন। পাড়ায় পাড়ায় বুথ অফিস খুলেছে, ৫০টি চেয়ার নিয়ে শুরু হওয়া সভায় ২৫০-৩০০ লোক হচ্ছে। কংগ্রেস নেতাদের দাবি, এ সবই আগামী দিনের জন্য অবশ্যই আশার আলো। আরেক দল কংগ্রেস নেতার কথায়, ‘‘এবার ভোটের পর আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচন। সেখানে কোনও জোট হলে যেমন দরাদরির জায়গা তৈরি হবে, তেমনই, দল একা লড়াই করলেও একটি তৈরি সংগঠনকে কাজে লাগানো যাবে।’’
গতবারের জেতা বোর্ডগুলির মধ্যে উত্তরবঙ্গের একমাত্র শিলিগুড়ি, কালিয়াগঞ্জ এবং ইসলামপুরই শেষ অবধি ধরে রাখতে পেরেছিল কংগ্রেস। আবার জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, ইংরেজবাজারের মতো পুরসভায় চেয়ারম্যান-সহ অধিকাংশ কাউন্সিলরই পরে শাসক দলে নাম লিখিয়েছেন। তাতে রাতারাতি বোর্ড উল্টেও যায়। তাই এবার উত্তর দিনাজপুরে দীপা দাশমুন্সি, কানাইলাল অগ্রবাল, কোচবিহারে শ্যামল চক্রবর্তী, মালদহে মৌসম বেনজির নূর, আবু হাসেম চৌধুরী বা জলপাইগুড়িতে পিনাকী সেনগুপ্তদের অস্তিত্বের লড়াই বলেই মনে করা হচ্ছে। আবার নিজের পুরানো ভিটে জলপাইগুড়ি ‘বাঁচাতে’ আদা জল খেয়ে ময়দানে নেমে পড়েছেন দেবপ্রসাদ রায়ও। মৌসম বেনজির নূরকে তাই বলতে হয়েছে, ‘‘আমরা উত্তরবঙ্গে আছি, আগামীতেও ভাল ভাবেই থাকব। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে কংগ্রেসের যথেষ্ট ভাল ফল করবে। কমিশন, পুলিশ-প্রশাসনকে নিয়েই চিন্তা থেকে যাচ্ছে।’’
আর কপালের সেই চিন্তার ভাঁজ নিয়ে ভোটের দিন, ২৫ এপ্রিল এলাকায় এলাকায় কর্মীরা নিজেদের কতটা একজোট করে রাখতে পারবেন, তাই এখন কংগ্রেসের কাছে চ্যালেঞ্জ।