Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

সহযাত্রীদের অত্যাচারে শিশুকে নিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দম্পতির

প্রায় দেড় দিন ধরে চলন্ত ট্রেনের মধ্যে ক্রমাগত উত্ত্যক্ত করছিল কয়েক জন সহযাত্রী। দেখা মেলেনি রেলরক্ষীদের। অভিযোগ, কামরা বদল করেও পিছু ছাড়েনি ধর্ষণের হুমকি। প্রাণে বাঁচতে অগত্যা স্ত্রী আর শিশুকন্যাকে নিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন স্বামী।

আহত হয়েছে দম্পতির দশ মাসের শিশুও। ছবি: নারায়ণ দে।

আহত হয়েছে দম্পতির দশ মাসের শিশুও। ছবি: নারায়ণ দে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
আলিপুরদুয়ার শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৫৬
Share: Save:

প্রায় দেড় দিন ধরে চলন্ত ট্রেনের মধ্যে ক্রমাগত উত্ত্যক্ত করছিল কয়েক জন সহযাত্রী। দেখা মেলেনি রেলরক্ষীদের। অভিযোগ, কামরা বদল করেও পিছু ছাড়েনি ধর্ষণের হুমকি। প্রাণে বাঁচতে অগত্যা স্ত্রী আর শিশুকন্যাকে নিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন স্বামী।

মঙ্গলবার রাতে আলিপুরদুয়ারের কাছে আপ মহানন্দা এক্সপ্রেসের সাধারণ কামরা থেকে ঝাঁপ দেওয়া এই পরিবারটিকে প্রথমে উদ্ধার করেন বনকর্মীরা। হাতি করিডরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল বলে ট্রেনের গতি কম ছিল। তাতেও তিন জনেরই গুরুতর চোট লেগেছে। মঙ্গলবার রাতেই তাঁদের আলিপুরদুয়ার রেল হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। সাধারণ কামরার যাত্রী বলে কারা ওই তরুণীকে উত্ত্যক্ত করছিল, তা এখনও জানতে পারেনি রেল। তবে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের আলিপুরদুয়ার ডিভিশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট সিকিউরিটি কমিশনার মুকুলচন্দ্র মেধি বলেন, “কারা ওই তরুণীকে হেনস্থা করেছে, তা জানতে আলিপুরদুয়ার জংশন স্টেশনের সিসিটিভি ফুটেজ বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে খতিয়ে দেখা হবে।’’

আহত ওই দম্পতির বাড়ি কোচবিহারের দিনহাটায়। বছর খানেক আগে তাঁরা দিল্লির কাছে গাজিয়াবাদে শাহপুরে ইটভাটায় কাজ করতে যান। বাবার শরীর খারাপের খবর পেয়ে সোমবার সকালে মহানন্দা এক্সপ্রেসে উঠেছিলেন তাঁরা। বছর সাতাশের ওই তরুণী জানান, কামরায় খুব ভিড় ছিল। তার মধ্যেই প্রায় ২০-২৫ জন যুবকের একটি দল দিল্লি থেকে ওঠে। অভিযোগ, প্রথম থেকেই তাঁকে উত্ত্যক্ত করতে থাকে তারা। যাতায়াতের পথে তাঁর শ্লীলতাহানিও করে। কিন্তু দেড় দিন ধরে কামরায় কোনও রেল পুলিশের দেখা পাননি তাঁরা। ফলে অভিযোগ জানানোর সুযোগও পাননি। শিশুকন্যাকে কোলে নিয়ে স্বামীর পাশ ঘেঁষে বসে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যাচ্ছিলেন সব। তবে কামরায় আরও লোক ছিল, সেটাই ভরসা জুগিয়েছিল দম্পতিকে। তার মধ্যে ওই যুবকদের অনেকে মাঝরাস্তায় নেমেও যায়।

কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে দম্পতি জানতেন, শিলিগুড়ির পরে কামরা অনেকটা ফাঁকা হয়ে যাবে। দুর্বিনীত সহযাত্রীদের যে পাঁচ-ছ’জন তখনও ট্রেনে রয়েছে, তখন তাদের দৌরাত্ম্য বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করে শিলিগুড়ির এক আত্মীয়কে তাঁরা ফোন করে স্টেশনে আসতে বলেন। কিন্তু ওই আত্মীয় আসতে পারেননি। ফলে ওই দম্পতিরও আর ট্রেন থেকে নামা হয়নি। তাঁদের অভিযোগ, এনজেপি ছাড়ার পরেই সহযাত্রীদের ওই দলটি কামরার মধ্যে গাঁজা খেতে শুরু করে। কামরা যথারীতি ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। কিছু ক্ষণ পরে শিশুকন্যাটি কাঁদতে শুরু করে। ওই তরুণীর স্বামী বলেন, ‘‘নেশাগ্রস্ত যুবকদের একজন মোবাইলে কথা বলার ফাঁকে আমার স্ত্রীকে ধর্ষণের হুমকি দেয়।’’ তাঁরা ঘাবড়ে যান। তখন প্রতিবাদ করলে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ করা হবে বলে হুমকি শুনতে হয় তাঁদের। যুবকেরা মূলত হিন্দিতে কথা বলছিল বলে ওই দম্পতি জানিয়েছেন।

তত ক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গিয়েছে। কিছু ক্ষণ পরে হাসিমারা স্টেশনে ট্রেন থামে। ওই তরুণীর স্বামী সেখানে স্ত্রী, কন্যাকে নিয়ে নেমে রেলকর্মীদের কাছ থেকে দিনহাটা যাওয়ার ট্রেন মিলবে কি না, জানতে চান। রেলকর্মীরা তাঁকে সোজা আলিপুরদুয়ার যাওয়ারই পরামর্শ দেন। ওই যুবকদের ব্যাপারে অভিযোগ জানানোর আগেই ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে যায়। ওই দম্পতি তখন দ্রুত অন্য একটি ফাঁকা কামরায় উঠে পড়েন। কিন্তু তাতেও লাভ হল না। ওই তরুণীর দাবি, ‘‘এই কামরার শৌচাগারের মধ্যে থেকে একদল লোকের হাসাহাসির আওয়াজ আসছিল। শুনতে পাচ্ছিলাম, আমার স্বামীকে বেঁধে রাখা হবে। তার পরে আমার উপর অত্যাচার চালানো হবে।’’ দম্পতির সন্দেহ হয়, ওই যুবকেরাই হয়তো পিছু নিয়ে এই কামরায় চলে এসেছে। তরণীর স্বামী বলেন, ‘‘ভয়ে বোধবুদ্ধি কাজ করছিল না। ট্রেনের গতি কমে গিয়েছে দেখে আমরা কামরাতেই জিনিসপত্র রেখে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ি।’’

রাজাভাতখাওয়া এলাকার বন দফতরের একদল কর্মীই তাঁদের উদ্ধার করেন। দফতরের গাড়ি চালক পঙ্কজ সোনার জানান, রাত সাড়ে দশটা নাগাদ রেলের ১৬২ নম্বর গেটের কাছে গিয়ে তাঁরা দেখেন এক পুরুষ ও মহিলা অন্ধকারে জঙ্গলের ধারে একটি বাচ্চা নিয়ে দাঁড়িয়ে। তিন জনের মাথা দিয়েই রক্ত পড়ছিল। তাঁদের গাড়িতে তুলে রাজাভাতখাওয়া স্টেশনে নিয়ে যান তাঁরা। বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মন বলেন, ‘‘বনকর্মীরাই ওঁদের প্রাথমিক চিকিৎসা করেন।’’ পরে আলিপুরদুয়ার হাসপাতালে রেল তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।

হাসিমারা স্টেশনের আরপিএফ কনস্টেবল প্রদীপ বড়গাঁও এবং পয়েন্টসম্যান বৈদ্যনাথ সিংহ পরে জানান, ওই ট্রেন থেকে নেমে এক ব্যক্তি সেদিন দিনহাটা যাওয়ার ট্রেন রয়েছে কি না, জিজ্ঞাসা করেছিলেন। কিন্তু কামরায় উত্ত্যক্ত হওয়ার
কথা বলেননি।

ছ’বছর আগে মহানন্দা এক্সপ্রেসেরই সাধারণ কামরায় ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল। তার পরেও যে যাত্রী-সুরক্ষার হাল ফেরেনি, এই ঘটনা ফের এক বার তা দেখাল। নিত্যযাত্রীদের অনেকেরই অভিযোগ, এই ট্রেনে নিরাপত্তা রক্ষীদের দেখা মেলে না। উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের আলিপুরদুয়ার ডিভিশনের ডিআরএম সঞ্জীব কিশোর বলেন, “আমরা তদন্ত শুরু করেছি। মহানন্দা এক্সপ্রেসে নিরাপত্তাও জোরদার করা হচ্ছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Couple Baby train MostReadStories
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE