প্রতীকী ছবি।
পিচ রাস্তার ধারে বাড়ির বারান্দায় গুম মেরে বসে রয়েছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ব্যক্তি। তিন শিশুর হই হুল্লোড়েও এক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে তিনি। কী ভাবছেন এত? প্রশ্ন শুনেই নড়েচড়ে বসলেন রোগা ছিপছিপে চেহারার মানুষটি। হাত তুলে দেখালেন, জমির পাকা ধান নষ্ট করছে গরু, ছাগল। তার পরেও ছুটে গিয়ে তাদের তাড়ানো তো দূর, চিৎকারও করতে পারবেন না, বলছিলেন তিনি। কেন? তাঁর কথায়, “জমির ও-পারেই বাংলাদেশের ভোলাহাট। কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা জমি। কাঁটাতার টপকাতে হলে অনুমতি নিতে হবে বিএসএফের। তাতে গড়িয়ে যাবে ঘণ্টাখানেক। আর চিৎকার করলে অভিযোগ উঠবে, পাচারকারীদের ‘ইশারা’ করছি আমি। মারও জুটতে পারে।”
শুনতে পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন চল্লিশার্ধ্ব এক মহিলা। তিনি বলেন, “নদীতে স্নান করতে যাচ্ছি ভোটার কার্ড নিয়ে। বিএসএফের হাতে কার্ড জমা দিয়ে নামতে হয় নদীতে। তার পরেও বিএসএফের ‘নজর’ থাকে আমাদের স্নানের উপরে।’’
এমনই ছবি হবিবপুরের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী গ্রাম শুকনগরের। ১৯৯৮ সাল থেকে কাঁটাতারের বেড়া বদলে দিয়েছে গ্রামের রোজনামচা। আঁধার নামতেই ঘরবন্দি সবাই। গ্রামের প্রবীণ এক বাসিন্দা বলেন, “পাখিরা বাসায় ঢোকার আগেই আমাদের ঘরে ঢুকতে হয়। কারণ, সন্ধ্যের পরে ঘরের বাইরে বের হলেই একগুচ্ছ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। এমনকি, জুটতে পারে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালিও।”
শুকনগরের মতোই কাঁটাতার বেড়া বদলে দিয়েছে হবিবপুরের যাদবনগর, কৃষ্ণপুর, ধুমবালু, আসরাফপুর, বাবুপাড়া, পুরাতন মালদহের মুচিয়ার সীমান্ত পারের বাসিন্দাদের জীবন। তাঁদের দাবি— ‘কথায় আছে নদীর পারে বাস, চিন্তা বারোমাস। কিন্তু নদী নয়, আমাদের কাছে সীমান্তপারে বাসই বারো মাস চিন্তায় রাখে।’ জন্মভিটে ছেড়ে অনেকেই সীমান্ত থেকে বহু দূরে গিয়ে নতুন করে ঘর বাঁধছেন। মৎস্যজীবী রমেশ হালদার বলেন, “বিএসএফ নদীতে নামার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত মাছ মারতে পারব। ঘড়ির কাঁটা দেখে তো আর জালে মাছ উঠবে না। তাই অনেকেই এখন বদলে ফেলেছেন পেশা।”
যাদবনগরের এক বাসিন্দা বলেন, “নারকেল, বাতাবি লেবু, লেবুর মতো বাড়ির পেছনে কিছু গাছ ছিল। আচমকা রাতে বিএসএফ ঢুকে সমস্ত গাছ কেটে ফেলল।” বিএসএফের দাবি, নজরদারিতে অসুবিধে হচ্ছে বলে গাছগুলি কাটা হল। সেই গাছের ফল বেচে রোজগার হত, আক্ষেপ তাঁর।
গ্রামবাসীরা বলছেন, এ সবের মূলে চোরাকারবারিরা। তাঁদের দাবি, কিছু মানুষ এই কারবারের সঙ্গে যুক্ত। তাদের জন্যই গ্রামের সবাইকে থাকতে হয় বিএসএফের সন্দেহের তালিকায়।
সীমান্তপারের সমস্যার কথা মেনে নেন উত্তর মালদহের বিজেপি সাংসদ খগেন মুর্মু। তিনি বলেন, “পাচারকারীদের জন্য সীমান্তের মানুষকে সমস্যায় পড়তে হয়। বিএসএফকে বহুবার বলেছি, যাতে মানুষের সমস্যা না হয়।”
বিএসএফের দক্ষিণবঙ্গ শাখার এক কর্তা বলেন, “গ্রামবাসীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেই সীমান্তে বিএসএফ কাজ করে। সীমান্তে প্রচুর সামাজিক কাজকর্মও করা হয়। তবে কোনও হয়রানির অভিযোগ পেলে অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy