Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

ছাদ ধসে মৃত্যু, আতঙ্কে অসুস্থ পড়ুয়ারা

হঠাৎ কম্পনে তোলপাড় চলল উত্তরবঙ্গ জুড়ে। শনিবার পুরভোট চলাকালীন দেওয়াল চাপা পড়ে এক মহিলা-সহ দু’জনের মৃত্যুতে কোথাও থমকালো ভোটের কর্মব্যস্ততা। কোথাও ফাটল ধরল স্কুল, হাসপাতাল, ঘর-বাড়ির দেওয়ালে। মৃতদের এক জন নকশালবাড়ির ও অন্য জন জলপাইগুড়ির আমবাড়ির বাসিন্দা। জখম হয়েছেন অন্তত ৫৫৫ জন। তবে কারও আঘাত গুরুতর নয়। শিলিগুড়ির প্রধাননগরে একটি বাড়ির ব্যালকনি ভেঙে গাছের ডালে আটকে গিয়েছে। সিকিমেও কম্পন অনুভূত হয়েছে।

ভূমিকম্পে অসুস্থ মালদহের রতুয়ার একটি স্কুলের পড়ুয়ারা (বাঁ দিকে)। বালুরঘাটের একটি বাড়ি দেওয়ালে ফাটল ধরেছে (ডান দিকে)। ছবিগুলি তুলেছেন বাপি মজুমদার ও অমিত মোহান্ত।

ভূমিকম্পে অসুস্থ মালদহের রতুয়ার একটি স্কুলের পড়ুয়ারা (বাঁ দিকে)। বালুরঘাটের একটি বাড়ি দেওয়ালে ফাটল ধরেছে (ডান দিকে)। ছবিগুলি তুলেছেন বাপি মজুমদার ও অমিত মোহান্ত।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৫ ০২:২৯
Share: Save:

হঠাৎ কম্পনে তোলপাড় চলল উত্তরবঙ্গ জুড়ে। শনিবার পুরভোট চলাকালীন দেওয়াল চাপা পড়ে এক মহিলা-সহ দু’জনের মৃত্যুতে কোথাও থমকালো ভোটের কর্মব্যস্ততা। কোথাও ফাটল ধরল স্কুল, হাসপাতাল, ঘর-বাড়ির দেওয়ালে। মৃতদের এক জন নকশালবাড়ির ও অন্য জন জলপাইগুড়ির আমবাড়ির বাসিন্দা। জখম হয়েছেন অন্তত ৫৫৫ জন। তবে কারও আঘাত গুরুতর নয়। শিলিগুড়ির প্রধাননগরে একটি বাড়ির ব্যালকনি ভেঙে গাছের ডালে আটকে গিয়েছে। সিকিমেও কম্পন অনুভূত হয়েছে। গ্যাংটক এবং তাদঙেই কম্পন সবচেয়ে বেশি অনূভূত হয়েছে।

পায়ে তিন জায়গায় হাড় ভেঙে গিয়ে ভূমিকম্পে কেউ জখম হয়ে, কেউ বা আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে দার্জিলিং জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। শনিবার সন্ধ্যে পর্যন্ত ৫৩ জন ভর্তি রয়েছেন বলে হাসপাতাল সূত্রের খবর। শিলিগুড়ি জেলা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ২০ জন। এঁদের মধ্যে ১৭জন মহিলা। হাসপাতাল সূত্রে জানানো গিয়েছে, রোগীদের ৪ জনের অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। এ দিন শিলিগুড়ি হাসপাতালে পরিদর্শনে গিয়েছিলেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। তিনি হাসপাতালে জানিয়েছেন, যাঁরা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন রাজ্য সরকার তাঁদের চিকিৎসার দায়িত্ব নেবেন। শহরের অন্যান্য নার্সিংহোমে কেউ ভর্তি রয়েছেন কিনা তাও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে বলে মন্ত্রী জানিয়েছেন। শিলিগুড়ি হাসপাতালে ভর্তিদের দেখতে গিয়েছিলেন শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মাও।

নকশালবাড়িতে ছাদ ধসে পড়ে এক মহিলা মারা গিয়েছেন বলে খবর পাওয়া গিয়েছে। এ দিন সন্ধেয় তাঁর বাড়িতে যান দার্জিলিং জেলা কংগ্রেসের সভাপতি তথা মাটিগাড়া-নকশালবাড়ির বিধায়ক শঙ্কর মালাকার। ঘটনার পর বেলা ১২টা থেকেই শিলিগুড়ি হাসপাতালের ইমারজেন্সি এবং অবর্জাভেশন ওয়ার্ডে ভিড় উপচে পড়ে। সন্ধে অবধি ১৫ জনের মতো হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। এনজেপির ডিএস কলোনির তরুণী ইশানি সাহা দোতলা থেকে নিচে নামতে গিয়ে পা মচকে উল্টে পড়েন। তিনি বলেন, ‘‘সিঁড়ি থেকে নামার সময় পা হড়কে পড়ে যাই। এখন আর হাঁটতে পারছি না। মনে হয়, ভেঙেই গিয়েছে। এক্সরে করা হচ্ছে।’’ ফুলবাড়ি লাগোয়া ঠাকুরনগরের বাসিন্দা মালতি মণ্ডল কাজ করছিলেন। ঘর থেকে দৌড়ে বার হতে গিয়ে তিনি উল্টে পড়েন। মালতি দেবীর কথায়, ‘‘ডান হাতটা মনে হচ্ছে ভেঙে গিয়েছে। ভাল করে বসতেও পারছি না।’’

ঘটনার পরেই হাসপাতালে পৌঁছন শিলিগুড়ির বিধায়ক রুদ্রনাথ ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘‘বহু মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। এতেই সমস্যা হয়েছে। শ্বাসকষ্ট, মাথা-ঘোরা, ভয়, পালাতে গিয়ে হাত পা ভাঙা নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন। হাসপাতাল সুপারের সঙ্গে কথা হয়েছে। মূলত পানিক অ্যাটাক বেশি হয়েছে।’’ এর পরেই হাসপাতালে যান সিপিএম নেতা অশোক ভট্টাচার্য ও জীবেশ সরকারেরাও।

হাসপাতাল সূত্রের খবর, ৫০ জনের উপর বাসিন্দা ভূমিকম্পের পর নানা কারণে হাসপাতালে আসেন। তাঁদের মধ্যে দফায় দফায় ১৬ জনকে ভর্তি করানো হয়। ছ’জনকে অবজার্ভেশন ওয়ার্ডে রাখা হয়। অনেকে বয়স্ক মানুষ হঠাৎ করে ভয়ে, আতঙ্কে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ায় অসুস্থ হয়েছে।

আলিপুরদুয়ারেও দু-দফার ভূমিকম্পে আতঙ্কিত হয়ে ঘর থেকে বার হন বাসিন্দারা। বহু স্কুলে ছাত্রদের নিয়ে শিক্ষকরা খোলা মাঠে গিয়ে দাঁড়ান। আলিপুরদুয়ার ম্যাকউইলিয়াম স্কুলের তিন তলার উপরে বেশ কিছু জায়গায় ফাটল ধরেছে বলে জানিয়েছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। আলিপুরদুয়ারের মহকুমা শাসক সমীরণ মণ্ডল বলেন, “কোথাও প্রাণহানি বা ক্ষয়ক্ষতির খবর নেই।”

ভূমিকম্পের জেরে দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরে বিভিন্ন এলাকায় বুথ থেকে প্রিসাইডিং অফিসারেরা বাইরে বেরিয়ে পড়েন। প্রায় এক মিনিট ভূমিকম্পের স্থায়িত্ব ছিল। এর জেরে মিনিট ১৫ ভোট গ্রহণ বন্ধ ছিল। বালুরঘাটে ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি ও স্থায়িত্ব ছিল এক মিনিটের উপর। শহরের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের শালবাগান পাড়া এলাকায় ভূমিকম্পে অমল বাগচীর বাড়ির সীমানা পাঁচিল ভেঙে পড়ে। বহু বাড়ির দেওয়ালে ফেটে যায়। বাসিন্দারা আতঙ্কে ঘর থেকে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। ফের দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিট নাগাদ হালকা ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে গঙ্গারামপুর।

ভূমিকম্পের জেরে ক্ষতি হয়েছে মালবাজারেও। সেখানে একটি উচ্চ বিদ্যালয় এবং একটি প্রাথমিক স্কুলের দেওয়ালে ফাটল ধরেছে। ভূমিকম্পে মালবাজার মহকুমায় বড় ধরনের কোনও ক্ষতি হয়নি। যে দু’টি স্কুলে ফাটল দেখা গিয়েছে সে দু’টি স্কুলের একটি মালবাজার ব্লকের ক্রান্তি দেবীঝোরা উচ্চ বিদ্যালয়। সেখানে একাধিক শ্রেণিকক্ষের দেওয়ালে ফাটল তৈরি হয়েছে বলে স্কুলের তরফে জানানো হয়েছে। এ ছাড়া নাগরাকাটা ব্লকের খয়েরকাটা বিএফপি প্রাথমিক স্কুলে পাঁচটি শ্রেণিকক্ষে বড় ফাটল তৈরি হওয়ায় পড়ুয়াদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। স্কুল চলাকালীন আচমকাই কম্পনের জেরে আতঙ্কে অসুস্থও হয়ে পড়ে মালবাজার ব্লকের রাজাডাঙা পেন্দা মহম্মদ বিদ্যালয়ের তিন ছাত্রী। তবে তাদের প্রথমে ক্রান্তি সারিপাকুড়ি গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হলে সেখান থেকে জুলিখা খাতুন এবং হাসিনা বানু নামের নবম শ্রেণির দুই ছাত্রীকে জলপাইগুড়ি জেলা হাসপাতালে পাঠানো হয়। তবে দু’জনেই সুস্থ রয়েছেন বলে জানান স্কুলের প্রধান শিক্ষক অনিরুদ্ধ শর্মা। মালবাজার পুরভোটে ভূমিকম্প আতঙ্ক ছড়ালেও পুরভোটের কোনও বুথেই অবশ্য ভূমিকম্পের জেরে কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। মালবাজারের মহকুমাশাসক জ্যোতির্ময় তাঁতি জানান মহকুমার সর্বত্র প্রশাসনিক তরফে ক্ষয়ক্ষতির খোঁজ নেওয়া হলেও ক্ষতির কোন খবর মেলেনি।

ভূমিকম্পের জেরে কোচবিহার শহরের বিশ্বসিংহ রোড এলাকায় একটি নার্সিংহোমের একাংশ ভেঙে পড়ে। এলাকার একটি বহুতলেও চাঙর খসে পড়েছে। গোটা ঘটনায় ভূকম্প প্রবণ এলাকা বলে চিহ্নিত কোচবিহারের বাসিন্দাদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। ক্ষুব্ধ বাসিন্দাদের অভিযোগ, শহরের নতুন বাজার থেকে নতুন পল্লি, মরাপোড়া চৌপথী থেকে রেলঘুমটি চৌপথী এলাকায় পরপর বহুতল তৈরি হচ্ছে। ওই বহুতল তৈরির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। একাধিক নির্মাণকাজ নিয়ে অভিযোগ উঠলেও তা নিয়ে গরজ দেখায়নি পুরসভা।

এ দিনের ঘটনায় শহরজুড়ে পরপর বহুতল তৈরির প্রবণতা নিয়ে ঘিরে বাসিন্দাদের ওই উদ্বেগ স্বাভাবিক ভাবে আরও বেড়েছে। কোচবিহারের জেলাশাসক পি উল্গানাথন বলেন, “একটি নার্সিংহোমের নির্মীয়মাণ একটি অংশ ভেঙে পড়েছে। বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা বলে বাড়ি তৈরির ব্যাপারে সতর্কতা বাড়ানো হয়েছে।’’ ক্ষুব্ধ বাসিন্দারা জানান, কোচবিহারে ২০১১ সালে ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সেবার কোচবিহার রাজবাড়ি দেওয়ালেও ফাটল তৈরি হয়। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে শেষ বার এক রাতে পরপর তিন বার ভূমিকম্পের জেরে কোচবিহারের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায়। তবে এ বার শহরের নার্সিংহোম ও বহুতলে ক্ষতির ঘটনা সেবার হয়নি। মাদারিহাটের বাসিন্দা মকবুল হোসেন বলেন, “বিশ্বসিংহ রোড এলাকার নার্সিংহোমে স্ত্রী চিকিৎসাধীন। ভূকম্পনের জেরে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নার্সিংহোমের ওপরের দিকের ইট খুলে পড়ায় ঘাবড়ে যাই।” এলাকার বাসিন্দা দিলীপ গুহের অভিযোগ, “আমার জলের ট্যাঙ্কটিও ভেঙেছে।”

বাসিন্দারা জানান, শনিবার আধ ঘণ্টার ব্যবধানে কোচবিহারেও দু’বার ভূমিকম্প হয়। প্রথমবার বেলা পৌনে ১২টা নাগাদ ও দ্বিতীয়বার সওয়া ১২টা নাগাদ ওই কম্পন অনুভূত হয়। কম্পনের তীব্রতা এতটাই ছিল যে বাড়িঘর, বিদ্যুতের খুঁটি, দোকানপাট রীতিমতো দুলতে শুরু করে। পুকুরের স্থির জলও বিভিন্ন এলাকায় উপচে পড়ে। কোচবিহার জেলা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সুব্রত সাহা বলেন, “এ বার ভাল রকমের কম্পন অনুভূত হয়েছে। কিছু ক্ষণের জন্য আমার মতো অসুস্থবোধ করেছেন। কোচবিহারে নতুন বহুতল তৈরিতে তাই সতর্কতা বাড়ানর পাশাপাশি পুরনো বহুতল, বাড়ির নিরাপত্তা নিয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় তা ভাবা দরকার।” মাথাভাঙা, তুফানগঞ্জ, দিনহাটা, মেখলিগঞ্জেও ভূমিকম্পে আতঙ্ক ছড়ায়। কম্পনের সময় ওই সব এলাকায় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্কে বাড়ি ছেড়ে খোলা জায়গায় বেরোতে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। পাড়ায় পাড়ায় মহিলারা উলুধ্বনিও করেন।

ছবি তুলেছেন সন্দীপ পাল, রাজকুমার মোদক, হিমাংশুরঞ্জন দেব, রাজা বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিশ্বরূপ বসাক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE