Advertisement
E-Paper

চিৎকার শুনেও ভাঙা গেল না তালা

বন্ধ ঘরে আগুনে ঝলসে মারা গেল দুই কিশোর। ঘরের চারপাশে তখন দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছে ঘর। কিন্তু দরজা বন্ধ। মালিক বাইরে থেকে তালা দিয়ে চলে গিয়েছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:১৪
এই খানেই পুড়ে গিয়েছিল ওই দুই শিশু। দেখাচ্ছেন এক বাসিন্দা। — বিশ্বরূপ বসাক

এই খানেই পুড়ে গিয়েছিল ওই দুই শিশু। দেখাচ্ছেন এক বাসিন্দা। — বিশ্বরূপ বসাক

বন্ধ ঘরে আগুনে ঝলসে মারা গেল দুই কিশোর। ঘরের চারপাশে তখন দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছে ঘর। কিন্তু দরজা বন্ধ। মালিক বাইরে থেকে তালা দিয়ে চলে গিয়েছে। ১১ ও ১৩ বছরের দুই কিশোর রবিবার মাঝ রাতে ঘুম থেকে উঠে প্রাণপণ চেষ্টাতেও তাই দরজা খুলতে পারেনি। সেখানেই ছটফট করতে করতে পুড়ে মারা গেল তারা। তাদের আর্ত চিৎকার এলাকার অনেকেরই কানে গিয়েছিল। কিন্তু আগুনের আঁচ সামলে তালা বন্ধ ঘরের দরজা ভেঙে দুই কিশোরকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

শিলিগুড়ির সেবক রোডে একটি ঝুপড়ি দোকানে কাজ করত বিহারের মজঃফরপুরের বাসিন্দা ওই দুই কিশোর। তাদের ঝলসানো দেহ উদ্ধার হয়েছে। তবে প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশের বক্তব্য, দেহ দু’টি প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষদের। ময়নাতদন্ত করতে পাঠানো হয়েছে দেহ দু’টি। এলাকার লোকজনের অবশ্য বক্তব্য, দুই কিশোরই আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছে। তবে তাদের নাম কেউই জানাতে পারেননি। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, তাদের লালু ও ছটু নামে ডাকা হত। বাড়ির ঠিকানাও সোমবার রাত পর্যন্ত জানা যায়নি।

এলাকার এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘দেহগুলি যদি দুই প্রাপ্তবয়স্কের হয়, তা হলে লালু ও ছোটু কোথায় গেল? ওরা তো এই দোকানেই রাতে ঘুমোতো।’’ খোঁজ মেলেনি ওই ঝুপড়ি দোকানের মালিক রাধেশ্যাম মাহাতোরও। রাধেশ্যামের বাড়িও মজঃফরপুরেই বলে আশেপাশের দোকানদাররা জানিয়েছেন। শিলিগুড়ির পরেশনগর এলাকায় সে ভাড়া থাকে। ঘটনার পর থেকে তার ঘরে তালা। পুলিশ গিয়ে তাকে পায়নি বলে জানিয়েছে।

রাধেশ্যাম রোজ রাতে দোকানে বাইরে থেকে তালা দিয়ে বাড়ি চলে যেত বলে জানিয়েছে স্থানীয় বাসিন্দারা। লালু ও ছোটু সারা দিন এই দোকানেই কাজ করত। তারপরে রাতে তারা দোকানের ঘরে ঘুমোতো। রাত দু’টো নাগাদ দোকানে আগুন লেগে যায়। দাউদাউ করে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। দু’টি কিশোর কণ্ঠের আর্ত চিৎকারে ঘুম ভাঙে এলাকার বাসিন্দাদের। আগুন তখন দোতলা সমান উঁচুতে উঠে গিয়েছে। আশপাশের বাসিন্দারা ছুটে এসে অনেকক্ষণ বুঝতেই পারেননি কোথা থেকে চিৎকার ভেসে আসছে। যখন বুঝতে পারলেন, তত ক্ষণে আগুনের গ্রাসে চলে গিয়ে‌ছে ওই দোকানটি সহ আরও কয়েকটি দোকান। দমকলকে ফোন করার প্রায় ৪০ মিনিট পরে তিনটি ইঞ্জিন যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছয়, তখন পাশাপাশি ছ’টি দোকানে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। থেমে গিয়েছে চিৎকার। দরজার তালা ভেঙে দমকলের লোকজন ভেতরে ঢুকে উদ্ধার করেছে ২ কিশোর হোটেলকর্মীর পোড়া দেহ।

কোথা থেকে আগুন লাগল, তা-ও পরিষ্কার নয় প্রশাসনের কাছে। ওই এলাকায় মোট ৩৪টি ঝুপড়ি দোকান রয়েছে। তার মধ্যে একটি ছোট রেস্তোরাঁ, একটি সেলুন, মিস্টির দোকান রয়েছে। হোটেলটিতে দু’টি কয়লার বড় উনুন রয়েছে। এ ছাড়া, ওই দুই কিশোর মশা তাড়াতে ডিমের কার্টন জ্বালিয়ে রাতে শুত বলেও জানা গিয়েছে। সেখান থেকে আগুন ছড়িয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। শর্ট সার্কিটের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না। বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, ওই এলাকায় বেশ কয়েকটি হোটেলে সন্ধ্যার পরে বেআইনি মদের আসর বসে। সে জন্য কয়েকটি হোটেলে প্রচুর বেআইনি মদ মজুত রাখা হয় বলেও সন্দেহ এলাকাবাসীর। তাই আগুন লাগার পরে মদের বোতল ফেটে তা আরও ভয়াবহ হয়ে যায় বলেও সন্দেহ করছেন অনেকে। পুলিশ জানিয়েছে, বেআইনি মদের কারবার হতো কি না সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা বলেন, ‘‘আমরা হোটেল মালিকের বিরুদ্ধে কর্তব্যে অবহেলা এবং অন্যকে বিপদে ফেলার মামলা দায়ের করছি।’’

শিলিগুড়ি ফায়ার স্টেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিষ্ণুপ্রসাদ ধর অভিযোগ করেন, ‘‘বাইরে থেকে দরজার তালা বন্ধ থাকায় ওই কিশোরদের বের করতে পারা যায়নি। তা ছাড়া ওই হোটেল সহ কোনও দোকানেই অগ্নি নির্বাপণের কোনও ব্যবস্থা নেই।’’ এমনকী তা আইনগতভাবে দেওয়াও সম্ভব নয় বলে জানান তিনি। কারণ গোটাটাই বেআইনি। দোকানগুলির কোনও রকম অনুমতিপত্রই নেই।

এলাকার লোকজন জানান, ওই কিশোরদের চিৎকার শুনে তাঁদের অনেকেই বাইরে চলে এসেছিলেন। আগুন নেভানোর চেষ্টাও করেছিলেন। তাঁদেরই এক জন বলেন, ‘‘আগুনের শিখা দাউ দাউ করে জ্বলছিল। এই সব দোকানে অনেক দাহ্য পদার্থ থাকে। তাতে আগুন বেড়ে গিয়েছিল হু হু করে। আমরা চেষ্টা করেও নেভাতে পারিনি।’’ অনেক চেষ্টা করেও দরজা খুলতে না পারায় ওই কিশোরদের বাঁচানো সম্ভব হয়নি বলে জানান একটি বেসরকারি সংস্থার ম্যানেজার চন্দ্র ভান।

তিনি বলেন, ‘‘আগুনে কাছে যাওয়া যাচ্ছিল না। তবু সামনের দরজা দিয়ে কয়েকজন মিলে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু দরজা খোলেনি।’’ একজন প্রত্যক্ষদর্শী গৌতম বিশ্বাস বলেন, ‘‘বাইরে থেকে তালা লাগানো থাকায় দরজা খোলা যায়নি। আমরা বেশি চেষ্টাও করতে পারিনি। কারণ আগুনের তাপে আমাদের গায়ে জ্বালা শুরু হয়ে গিয়েছিল।

স্থানীয় বাসিন্দাদের কারও মনে পড়ে যাচ্ছে রমাপদ চৌধুরীর লেখা উপন্যাস, মৃণাল সেনের সিনেমা খারিজের কথা। কারও মনে পড়ে যাচ্ছে ওম শান্তি ওম সিনেমাটির কথা। গোটা এলাকাই গভীর বিষাদে ছেয়ে আছে। চেষ্টা করেও যে তাঁরা বাঁচাতে পারেননি দুই কিশোরকে।

Lock Break
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy