বিসর্জনের শোভাযাত্রায় বক্স বাজিয়ে উদ্দাম নাচ। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।
শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়িতে তো রাস্তা আটকে চড়া শব্দের বাজি ফাটিয়ে তারস্বরে ডিজে বাজানো হয়েছে। মঙ্গলবার পুলিশের সামনেই বিধান রোড, হিলকার্ট রোড আটকে বাজি ফাটিয়ে ডিজে বাজিয়ে বিসর্জন মিছিল করেছে একাধিক ক্লাব। জলসার নামে বুক কাঁপানো শব্দে ডিজে বেজেছে দুই শহরেই। শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার চেলিং সিমিক লেপচা বলেন, ‘‘আমরা ডিজে, মাইক বাজানোর ক্ষেত্রে বিধি ভঙ্গ হচ্ছে কি না সে দিকে নজরদারি চালিয়েছি। অনেক জায়গায় মাইক, ডিজে বাজানো বন্ধ করিয়ে সতর্ক করা হয়েছে।’’
কিন্তু দুই শহরের বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতা অন্য রকম। শব্দদূষণ শুরু হয়েছিল দুর্গাপুজো থেকে। কালীপুজোয় তা মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। মঙ্গলবার কোন বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে শেষ রাত্রি পর্যন্ত মাইক বাজানো হল জলপাইগুড়িতে। দুটি পুজো কমিটি বাদে অনেকেই লাগামছাড়া মাইক বাজিয়েছেন বলে অভিযোগ। বাসিন্দাদের আপত্তি সত্বেও যুবমঞ্চের অনুষ্ঠানে ডিজে বক্স এবং মাইক বেজেছে ভোর পর্যন্ত। প্রশাসনের উদাসীনতায় অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। পরিবেশপ্রেমীরা প্রশাসনের ভূমিকায় প্রশ্ন তুলেছেন।
জলপাইগুড়িতে পুজোর মরসুম শুরু হওয়ার আগে সমস্ত পুজো কমিটির সঙ্গে সভা করে প্রশাসন থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে দুর্গাপুজো এবং কালীপুজোতে মাইক এবং ডিজে বক্স রাত দশটা পর্যন্ত বাজানো যাবে। তার পরে মাইক বাজালে বিধিভঙ্গ হবে। দুর্গাপুজোয় মাইক বেশি রাত পর্যন্ত বেজেছে। কিন্তু কালীপুজোর মাইক-চিত্র অনেকের কাছেই উদ্বেগের। জলপাইগুড়ি শহরের অন্যতম পুজো কমিটি যুব মঞ্চের পুজোর ‘প্রাণপুরুষ’ (মাইকে পুজো কমিটির পক্ষ থেকে এভাবেই প্রচার করা হচ্ছিল) পুরসভার চেয়ারম্যান মোহন বসু। তার পুজোয় চারদিনের মধ্যে প্রথম তিন দিন রাত দুটো পর্যন্ত মাইক বেজেছে। মঙ্গলবার রাতের অনুষ্ঠান ভোর চারটের সময় শেষ হয়। ভোর পর্যন্ত অনুষ্ঠানের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন ক্লাবের কর্তারাও৷ তবে তারস্বরে বক্স বাজানোর কথা মানতে চাননি তারা ৷ ক্লাবের সহকারী সম্পাদক শুভেন্দু বসুর কথায়, “এই পুজোকে ঘিরে গোটা শহরের মানুষই আনন্দে মাতেন৷ এবং তাদের ভাল লাগার উপরই পুজো ও অন্যান্য অনুষ্ঠান হয়৷ সে জন্যই গত বছর অনুষ্ঠান ভোর প্রায় সাড়ে চারটা পর্যন্ত হয়েছিল৷ এবার ভোর পর্যন্ত চললেও বক্সের শব্দ সীমার মধ্যেই রাখা হয়েছিল৷” শুভেন্দুবাবুর কথায়, “আমাদের পুজোর সম্পাদক খোদ পুরসভার চেয়ারম্যান মোহন বসু৷ ফলে আমরা এমন কোন কাজ করব না যাতে করে মানুষের সমস্যা হয় ৷”
মোহনবাবুর বক্তব্য, ‘‘নির্দিষ্ট সময়েই অনুষ্ঠান শেষ হত। কিন্তু শ্রোতাদের চাপেই একের পর এক গান গাইতে হয়েছে গায়ক-গায়িকাদের।’’
যদিও ডিজে বক্স এবং মাইকের স্বরে সমস্ত মুহুরিপাড়া এবং উকিলপাড়ার বাসিন্দারা অনেকেই ঘুমোতে পারেননি। পুজো প্রাঙ্গণ সোনাউল্লা স্কুলের উল্টো দিকে সত্যেন্দ্রপ্রসাদ বিশ্বাস সরণির বাসিন্দারা কালীপুজোর আগে প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে পুজোর সময় অনুষ্ঠানে মাইক বাজানো বন্ধের কথা জানিয়েছিলেন। প্রশাসন থেকে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বাসিন্দা বলেন, “প্রায় সব পুজোয় ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা আছেন। ওঁদের বিরুদ্ধে মুখ খুলবে কার সাধ্য আছে। শব্দদূষণের জন্য আমরা নাজেহাল হচ্ছি। এইসব অসুরদের বিরুদ্ধে কেউ কিছুই করতে পারবেনা।”
বড়পুজো কমিটিগুলোর মধ্যে দাদাভাই ক্লাবের মাইক রাত বারোটা পর্যন্ত বেজেছে। মুনলাইট ক্লাবের লটারি ছিল। রাত বারোটা পর্যন্ত মাইক বেজেছে। শহরের দুটি পুজো কমিটি অন্য ভুমিকা পালন করে। রায়কতপাড়ার স্বস্তিকা পুজো কমিটির কাছে স্থানীয় বাসিন্দারা গিয়ে আবেদন জানালে তারা তাদের দাবি মেনে রাত এগারোটার সময় মাইক বন্ধ করে দেয়। পান্ডাপাড়ার সার্ফের মোর এলাকায় এককজন কিশোরের মৃত্যুর জন্য উত্তরপল্লির পুজোর মাইক বাজানো বন্ধ করে দেওয়া হয়।
লাগাম ছাড়া মাইক বাজানোর জন্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন সমাজিক সংগঠনগুলির সদস্যরা। জলপাইগুড়ি সায়েন্স এন্ড নেচার ক্লাবের সম্পাদক রাজা রাউথ বলেন, “সম্পূর্ণ ভাবে প্রশাসনের গাফিলতি। আইন ভাঙা হচ্ছে। শহরের বাসিন্দাদের শব্দের আওয়াজে মাথাখারাপ হয়ে যাচ্ছে। প্রশাসন এবং পুলিশ কিছুই করছে না। প্রশাসনে এবং পুলিশ এ বিষয়ে কঠোর না হলে এই দূষণ থামবে না। বেড়েই চলবে।” জলপাইগুড়ি ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশনের সম্পাদক সঞ্জয় চক্রবর্তী বলেন, “শহরে মাত্রা ছাড়া ভাবে মাইক বেজেছে। শব্দ দূষণ যাদের দেখা উচিত তারা ঘুমিয়ে আছে। তারা পদক্ষেপ নিলে এই ঘটনা ঘটতো না।”
জলপাইগুড়ির মহকুমাশাসক সীমা হালদারকে সমস্যার কথা জানালে প্রথমে তিনি বলেন, “আমি একটি মামলার শুনানিতে আছি।” পরে আবার ফোন করা হলে তিনি ফোন না ধরে মেসেজ পাঠান যে তিনি একটি সভায় আছেন। জলপাইগুড়ির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভোলানাথ পান্ডে বলেন, অভিযোগ পেলে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেওয়া হবে ৷’’
কোচবিহার, আলিপুরদুয়ারে অবশ্য তুলনায় ডিজের উপদ্রব কম বলে জানিয়েছেন বাসিন্দাদের অনেকেই। তবে রাত ১০টার পরে তারস্বরে মাইক বাজানোর ঘটনা ঘটেছে ওই দুই জেলাতেই। একমাত্র দার্জিলিং পাহাড়ে সন্ধ্যার পরে কোথাও চড়া শব্দে মাইক কিংবা ডিজে বাজানোর ঘটনা ঘটেনি বলে পুলিশের দাবি। অভিযোগ নেই বলে দায় এড়িয়েছে উত্তর দিনাজপুরের জেলা পুলিশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy