বোর্ড গঠনের পরে পুরসভার সংবর্ধনা সভায় বক্তার তালিকায় নাম ছিল না নির্দল কাউন্সিলর অরবিন্দ ঘোষের। নতুন পুরবোর্ড গঠনের পরে প্রথম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে। পাকুড়তলা মোড়ে যেখানে, অনুষ্ঠান হবে সেটি ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের সীমানা। ১৫ নম্বর ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত হয়েছেন নির্দল কাউন্সিলর অরবিন্দবাবু। একসময়ে নাটকের মঞ্চের নিয়মিত উপস্থিত থাকা অরবিন্দবাবু সংস্কৃতি জগতের লোক বলে পরিচিত। বামেদের সমর্থন দেওয়ার প্রস্তাবে তিনিই পুরবোর্ডে ‘গণতান্ত্রিক পরিবেশ’ বজায় রাখার কথা লিখেছেন। অথচ, বোর্ডের প্রথম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কথা জানতে পেরেছেন আমন্ত্রণপত্র হাতে পেয়ে। নিজের ওয়ার্ডের দোরগোড়ায় হলেও অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা বা আয়োজনেই ‘অমুদা’কে ‘ব্রাত্য’ই রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ।
এই দুই ঘটনায় ক্ষুব্ধ অরবিন্দবাবুর ওয়ার্ডের বাসিন্দারা। শুধু তাঁরাই নন, নতুন পুরবোর্ডের কিছু আচরণে প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধী দলগুলিও। মেয়র, চেয়ারম্যান এবং নব নির্বাচিত কাউন্সিলরদের সংবর্ধনা সভার সরকারি অনুষ্ঠানে বামেদের গণ সংগঠনের সক্রিয় নেতা-কর্মীরা ‘দখল’ নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। নজরুল জয়ন্তীর অনুষ্ঠানেও বামপন্থী গণ সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করেই অনুষ্ঠানসূচি স্থির করা হচ্ছে বলে অভিযোগ।
পুরসভার মেয়র অশোক ভট্টাচার্য অবশ্য দলতন্ত্রের অভিযোগের কোনও ভিত্তি নেই বলে দাবি করেছেন। সকলকে নিয়ে চলার কথাও বলেছেন মেয়র। তবে, উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী তথা তৃণমূলের দার্জিলিং জেলা সভাপতি গৌতম দেবের অভিযোগ, ‘‘দলতন্ত্র সিপিএমের মজ্জাগত। ৩৪ বছরের বাম শাসনের সময়ে সকলেই তার ভুক্তভোগী। শিলিগুড়ি পুরবোর্ড গঠনের পরেও অনেকেই তেমন প্রবণতা দেখতে পাচ্ছেন। এখনই কিছু বলতে চাইছি না। সঠিক সময় এলে বাসিন্দারাই সরব হবেন।’’
শিলিগুড়ি পুরসভায় বামেরা ২৩টি আসনে যেতে। পুরবোর্ডে সংখ্যাগরিষ্ঠতার থেকে একটি আসন কম পাওয়া বামেদের সমর্থনে রাজি হন নির্দল কাউন্সিলর অরবিন্দবাবু। সমর্থনের ভিত্তি হিসেবে বেশ কিছু লিখিত প্রস্তাবও তিনি দিয়েছিলেন। যার প্রথম প্রস্তাবে লেখা রয়েছে, ‘পুরবোর্ডে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখতে হবে।’ শপথ নেওয়ার পাঁচ দিনের মাথায় নতুন বোর্ডের গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিয়েই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এ বিষয়ে এখনই কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি অরবিন্দবাবু। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমার এ বিষয়ে কিছু বলার নেই।’’ যদিও, ঘনিষ্ঠদের একাংশের দাবি, একান্তে এ বিষয়ে তিনি নিজের উষ্মা গোপন রাখেননি। এ বছরে আঠান্নোয় পা দেওয়া অমুদা তথা অরবিন্দবাবু মন্তব্য করতে না চাইলেও, তাঁর ওয়ার্ডের বিশিষ্টজনেরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালেয়র অধ্যাপক দেবব্রত মিত্রের আক্ষেপ, ‘‘নতুন বোর্ডের সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে অবশ্যই অমুদাকে বলতে দেওয়া উচিত ছিল। তাঁর নিজের সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গী রয়েছে। বক্তব্য পেশ করতে দিলে তাঁর সৃজনশীল দিকটা শহরের মানুষের কাছে পৌঁছত।’’ ওই ওয়ার্ডেরই বাসিন্দা সমাজসেবী শেখর পালও অভিযোগ করেন, ‘‘অমুদাকে বলতে না দেওয়ায় আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছি। যাঁকে ছাড়া বোর্ড হতো না। তাঁকে নিজের বক্তব্য জানাতে দেওয়া উচিত ছিল। তাঁর এটুকু সম্মান প্রাপ্য ছিল।’’ পেশায় ব্যবসায়ী কাকলি সরকারের মন্তব্য, ‘‘অমুদাকে বলতে না দেওয়া অন্যায় হয়েছে। ওঁর বক্তব্য শহরবাসীর কাছে পৌঁছনো দরকার ছিল। সকলেরই জানা উচিত অমুদাকে আমরা কেন ভোট দিয়েছি। ভালভাবে কাজ চালাতে গেলে বোর্ডের অমুদাকে ছাড়া কোনও গতি নেই।’’ এমনকী, ওয়ার্ডের একাধিক বাসিন্দার অভিযোগ, শপথগ্রহণের মঞ্চে একজন কলেজ শিক্ষক যে ভাবে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তা অত্যন্ত দৃষ্টিকটূ। এমনকী, সরকারি মঞ্চে ঘোষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময়ে অমুবাবুকে অবজ্ঞা করা হয়েছে বলেও তাঁর অনুগামীদের অনেকের অভিযোগ।
মেয়র অশোকবাবু অবশ্য দাবি করেছেন, সংবর্ধনা মঞ্চে তিনি ছাড়া অন্য কারও বক্তৃতা রাখার কথা ছিল না। যদিও ওই মঞ্চ থেকেই সিপিএমের জেলা সম্পাদক জীবেশ সরকার এবং কাউন্সিলর নুরুল ইসলামকে বক্তৃতা দিতে দেখা গিয়েছে। অশোকবাবুর যুক্তি, ‘‘ওঁরা শুধু এক লাইন বলে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন। অরবিন্দবাবু অনেক সময়ে নিজেও বক্তব্য রাখতে চান না।’’ নজরুল জয়ন্তীর অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে অশোকবাবুর মন্তব্য, ‘‘এলাকার বিভিন্ন ক্লাবকেও অনুষ্ঠানে সামিল হতে আহ্বান জানানো হয়েছে। বামপন্থী শিল্পী সংগঠনকেও ডাকা হয়েছে। সকলকে নিয়েই চলা হবে।’’
গত সোমবারের সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে বাম নেতাদের একাংশের আচার-আচরণেও ‘গায়ের জোরে’ সরকারি মঞ্চ দখলের প্রবণতা ফুটে বেরিয়েছে বলে অভিযোগ। সভামঞ্চে মেয়র সহ অনান্যরা উপস্থিত হওয়ার পরে উদ্বোধনী সঙ্গীতের পরে বক্তব্য রাখার কথা ছিল। যদিও, উদ্বোধনী রবীন্দ্রসঙ্গীত শুরু হতেই, এক কাউন্সিলর গান থামিয়ে দিতে উদ্যোগী হন বলে অভিযোগ। পরে বামেদেরই এক প্রবীণ কাউন্সিলর তাঁকে থামান। বোর্ডে আলোচনা ছাড়াই বিশ্ব পরিবেশ দিবসের অনুষ্ঠান নিয়ে দলের এক কাউন্সিলর তাঁর ফেসবুক পেজ-এ মতামত চাওয়া নিয়েও বির্তক তৈরি হয়েছে।
কংগ্রেস কাউন্সিলর সুজয় ঘটক সব অভিযোগগুলিকেই ‘প্রত্যাশিত’ বলে মনে করছেন। তাঁর মন্তব্য, ‘‘যাঁরা বোর্ডে রয়েছেন, শহরের বাসিন্দারা তাঁদের নাড়ি-নক্ষত্র চেনেন। এক সময়ে সিপিএমের কাউন্সিলরদের কয়েকজনের ঔদ্ধত্য, দলতন্ত্রের বিরুদ্ধে সর্বস্তরে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। যে কোনও সরকারি মঞ্চ দলের লোকদের দিয়ে ভরানোর সংস্কৃতিতে বামেরা চেয়ে তৃণমূলের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেন, সেটাও ফের শহরবাসীরা টের পাচ্ছেন। এটা কখনও কাঙ্খিত নয়। মনে রাখতে হবে, বামেরা কিন্ত এককবাবে বোর্ড গড়েনি। একজনের প্রত্যক্ষ সমর্থন ছাড়া বামেরা কিন্তু সংখ্যালঘু।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy