Advertisement
E-Paper

আজ দেবীপক্ষ

বাতাস মধুময় হোক, মধু হোক ধূলি। উমা আসছেন ঘরে। বরণ থেকে বিসর্জন পর্যন্ত দশভুজার দশ কৃত্যের কথা জানাচ্ছেন অনিতা দত্ত।বাতাস মধুময় হোক, মধু হোক ধূলি। উমা আসছেন ঘরে। বরণ থেকে বিসর্জন পর্যন্ত দশভুজার দশ কৃত্যের কথা জানাচ্ছেন অনিতা দত্ত।

শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০১:৪৪

প্রতিপদ থেকেই শুরু

শিলিগুড়ির হাকিমপাড়ার ‘সুপ্রভা ভবন’-এর পারিবারিক পুজোটি এ বার ৭০ বছরে পা রেখেছে। পরিবারের গৃহকর্ত্রী স্বপ্না রায় ২৫ বছর ধরে পুজোর কাজ সামলাচ্ছেন। তাঁর পুজো শুরু হয়ে যায় মহালয়ার পর দিন প্রতিপদ থেকেই। সে দিন থেকেই শুরু করেন সংযম। পুজোর দিনগুলোয় তাঁর সকাল শুরু ভোর ৪টেয়। তার পর ফল কাটা, নৈবেদ্য সাজিয়ে দেওয়া, মহাস্নানের যাবতীয় খুঁটিনাটি পুরোহিতের হাতে তুলে দেওয়া থেকে শুরু করে নবমীর যজ্ঞের সামগ্রী সাজিয়ে দেওয়া, সবই করে আসছেন তিনি। এ সবের মাঝেই আবার হেঁসেলও সামলাতে হয়। স্বপ্নাদেবীর কথায়, ‘দশমীর দিন মাকে বরণ করতে গিয়ে নিজের থেকেই মনটা কেমন হু হু করে ওঠে, চোখে জল আসে।’’

তাঁকেও চাই

যথাবিহিত নিয়মে দুর্গাপুজো সম্পন্ন করতে হলে চাই ‘বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকা’। পুজো উদ্যোক্তারা অনেকেই গোপনে তা সংগ্রহ করেন। দুর্গাপুজোর এই আচার অবশ্য যৌনকর্মীদেরও অজানা নয়। জলপাইগুড়ির তিনকুনিয়া মোড় অঞ্চলের যৌনকর্মী টুম্পা জানান, ‘সমাজ আমাদের একঘরে করে রাখলেও—পুজোর দিনগুলোতে যে আমরাও প্রয়োজনীয়, সেটা ভেবেই খুব ভাল লাগে।’

১০৮টি পদ্ম

চন্দন রায়ের সংগ্রহ করা ১০৮টি পদ্মফুল ছাড়া মালদহের সিংহাবাদ-তিলাসজোড় জমিদার-বাড়ির সন্ধি পুজো হয় না। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে এ কাজ করছেন চন্দনবাবু। পুজোর আট দিন আগে থেকে বাঁশের ডগায় কাছি বেঁধে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েন। ধূমপুর, খালপুর, কালাইবাড়ি, নিমবাড়ির পুকুর বিলের জলে নেমে সংগ্রহ করেন পদ্ম। সন্ধ্যায় জমিদারবাড়িতে সেই ফুল জমা দিয়ে বাড়ির পথ ধরেন। কাঁটা বাঁচিয়ে খুব সাবধানে এ ফুল তুলতে হয়। ‘‘আর প্রচুর জোঁক রয়েছে জলে, রয়েছে বিষাক্ত সাপ। কিন্তু যখন দেখি সন্ধিপুজোয় আমারই তোলা পদ্ম দেওয়া রয়েছে, সে সব মনে থাকে না।’’ বলেন চন্দন রায়।

ভোলেনি অষ্টমী

সে বার জলপাইগুড়ির রামকৃষ্ণ মিশনের পুজোয় তাঁকেই কুমারী রূপে পুজো করা হয়। সেই স্মৃতি আজও টাটকা মালবাজার সিজার্স স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীটির মনে। নাগরাকাটার সুথানি বস্তি থেকে পুজোর দু’দিন আগেই মা-বাবার সঙ্গে মিশনের অতিথিনিবাস। অষ্টমীর সকালবেলায় স্নান সেরে দুর্গা সাজা শুরু হল অদ্রিজা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। পরানো হল লাল বেনারসি, সোনার দুল আর প্রচুর গয়না। মুকুটও। কাঠের চেয়ারে বসিয়ে, মাথায় ছাতা ধরে, ভিড় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল তাকে মন্দিরে। তাকে দেবীজ্ঞানে পুজো করেছিলেন সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারী মহারাজরা। ‘‘শাড়ি গয়নার সঙ্গে পেয়েছিলাম প্রচুর চকোলেটও।’’ হাসে অদ্রিজা।

তন্ত্রধারক

ষষ্ঠীর কল্পারম্ভ থেকে দশমীতে বিধি মতে বিসর্জন—পুজোর আনুষ্ঠানিক কৃত্য যাঁর পরিচালনায় সম্পন্ন হয়, তিনি তন্ত্রধারক। তাঁর ‘গাইডলাইন’ মেনেই পুরোহিত পুজো করেন। তন্ত্রধারক ছাড়া এই মহাপুজো সম্পন্ন করা শুধু কঠিন নয়, অসাধ্যও। দার্জিলিং রামকৃষ্ণ বেদান্ত আশ্রমের দুর্গাপুজোয় পাঁচ বছর ধরে কাজটি করে আসছেন স্বামী সুশান্তনন্দ মহারাজ। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মেনে দুর্গাপুজো হয় এখানে। সামনে থাকে পূজাপদ্ধতির গ্রন্থ ‘বৃহনন্দী কেশর পুরাণতত্ত্ব’। বিধি অনুযায়ী কখন আবাহন, নির্ঘণ্ট মেনে চার দিনের পুজোর যাবতীয় খুঁটিনাটি, মন্ত্রপাঠ, মুদ্রা প্রদর্শন, পুজোর দ্রব্য এগিয়ে দেওয়া—সবই তাঁর নির্দেশ মেনেই পালন করে যান পুরোহিত।

বিসর্জনে

দীর্ঘ ৪৩ বছর ধরে তাঁর নৌকাতেই হয় প্রতিমা বিসর্জন। তিনি মাঝি হেলা বর্মন। তুফানগঞ্জ রায়ডাক ১ নম্বর নদীর পাড় থেকে তিনটি নৌকো জোড়া দিয়ে প্রতিমা সমেত উদ্যোক্তাদের উঠিয়ে, উজানে নৌকো চালিয়ে নিয়ে যান ২ কিলোমিটার দূরে উজানগঞ্জ শহর সংলগ্ন ২ নম্বর রায়ডাক নদীতে। হাল ধরেন ১২ জন। সেখানকার নদীবক্ষে তখন বিসর্জনের জন্য হাজির তুফানগঞ্জের অন্যান্য প্রতিমাও। তার পর বিধি মেনে সেই নৌকা সাত পাক ঘোরানো। অবশেষে নৌকো থেকেই সাঙ্গ হয় নদীর জলে প্রতিমা নিরঞ্জনের পালা। ‘আগে দু’টি বড় জোড়া-নৌকোতে প্রায় দে়ড়শো জন উঠত প্রতিমা নিরঞ্জনের জন্য। আর এখন সেখানে ৬০ জন। নৌকাতে প্রতিমা উঠলেই মন খারাপ লাগে। তবু পেটের দায়ে এ কাজ করতে হয়’ বললেন হেলা।

পুরোহিত

‘ওঁ জটাজুট সমযুক্তাং...’

চোখ বুজে এই ধ্যানমন্ত্র পাঠ করলেই মনে হয়, মা সাক্ষাৎ সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। সে এক অন্য রকম অনুভূতি— জানালেন পুরোহিত অমরশঙ্কর মুখোপাধ্যায়। ২০ বছর ধরে মালদহের গাজল থানার রানিপুর জমিদারবাড়ির দুর্গাপুজো সম্পন্ন করে আসছেন। তারও আগে পুজো করতেন দানবত্রাস জমিদারবাড়িতে। এখন ৫৮। সেই কোন ১৭ বছর বয়স থেকে বাবা প্রয়াত ক্ষেত্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে শিখেছেন দুর্গাপুজোর পৌরোহিত্যের কাজ। তাঁর কথায়, ‘অষ্টমীর অঞ্জলি, আরতি কিংবা সন্ধিপুজোর সময় প্রচুর মানুষ উপস্থিত হন। সে সময়ে সত্যিই বড় ভাল লাগে।’

দেবীপক্ষে দশভুজার দশ কৃত্য...

মহাপ্রসাদ

রায়গঞ্জের প্রাচীন পুজো ‘বন্দর আদি সর্বজনীন’-এর মহাপ্রসাদ রান্না করে আসছেন নারায়ণ মুখোপাধ্যায় প্রায় ২০ বছর ধরে। অষ্টমী ও নবমী মিলিয়ে প্রায় সাড়ে চার হাজার লোকের হাতে প্রসাদ তুলে দেন। তালিকায় থাকে কখনও খিচুড়ি ও লাবড়া বা আলুমটরের সব্জি, কখনও লুচি-পায়েস বা ফ্রায়েড রাইস। আশি বছরের নারায়ণবাবু ১১ জন সঙ্গী নিয়ে রাত ২টো থেকেই শুরু করেন তাঁর কর্মযজ্ঞ। চারটে কাঠের উনুন ও দুটি গ্যাসের ওভেনে শুরু হয় চার কুইন্টাল চালের খিচুড়ি, দেড় কুইন্টাল দুধের পায়েস, পঞ্চাশ কেজি ছোলার ডাল তৈরির প্রস্তুতি। পর দিন বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে রান্না শেষ করতেই হয়, কারণ দর্শনার্থীরা ভোগ খেতে উপস্থিত হবেন।

চণ্ডীপাঠ

চণ্ডীপাঠ করছেন সেই ১৯৭৯ থেকে। বাবা-কাকারা চাকরির সঙ্গে যজমানি করতেন। আর তিনি রঘুনাথ চক্রবর্তী পুরোপুরি বেছে নিয়েছেন যজমানির জীবন। দুর্গাপুজো এলেই চণ্ডীপাঠের ডাক পড়ে তাঁর। চণ্ডীপাঠ করতে গিয়েছেন গুয়াহাটি, বিহার, মালদহ, কলকাতা, দুর্গাপুরে। ষষ্ঠাদি কল্পারম্ভে চণ্ডীর ঘট স্থাপনের পরই শুরু হয় চণ্ডীপাঠ। কেউ আবার প্রথা মেনে প্রতিপদ থেকে মহানবমী পর্যন্ত চণ্ডীপাঠ করান। মহাশক্তির ব্যাখ্যা রয়েছে চণ্ডীতে। তাই দুর্গাপুজোয় চণ্ডীপাঠ আবশ্যক। ষষ্ঠী তিথি থেকে নবমী পর্যন্ত পুরো গ্রন্থটিকে তিন বার পাঠ করতে হয়। একে বলা হয় ‘ত্রিরাবৃত্তি চণ্ডী’। সপ্তম শতকের দেবীমাহাত্ম্য গ্রন্থের একটি অংশ চণ্ডী, তাই এখন দুর্গাপুজোর শাস্ত্রবিধি।

২৪ বছর ধরে

১৮৯০ থেকে কোচবিহার মদনমোহন বাড়িতে দেবী দুর্গা পূজিতা হয়ে আসছেন। মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরে কোচবিহারের রাজাদের কুলাচার মেনে ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত বলি হয়ে আসছে আজও। এখানে গত ২৪ বছর ধরে বলিদানের কাজটি করে আসছেন অনুপকুমার লায়েক। সম্পূর্ণ দেবোত্তর ট্রাস্টের অধীন ‘দেবীবাড়িতে’ বলিদান পর্ব সম্পন্ন হয় তাঁর হাত দিয়েই। অনুপবাবু ব্যবহার করেন রাজ আমলের ১৯২২ সালে তৈরি খাঁড়াটি। অন্য খাঁড়াটিও রাজ আমলেরই। ‘বাপ-ঠাকুর্দা এই কাজ করতেন। প্রথম দিকে খারাপ লাগলেও এখন মনটা অন্য রকম হয়ে যায়। এখনও খারাপই লাগে। কৃত্য বলে করেন।

mahalaya durga puja
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy