আমসত্ত্ব তৈরি করছেন মহিলারা মালদহে। নিজস্ব চিত্র
আমের জেলা মালদহ। অথচ আমের জেলা হলেও মাত্র তিন থেকে চার মাস আম-আদমির পাতে পড়ে গোপাল ভোগ, হিমসাগর, ল্যাংড়া, ফজলির মতো সুস্বাদু আম। তবে জেলাবাসীর আমের রসনা তৃপ্তি সারা বছর পূরণ করে আমসত্ত্ব। বাগানে গাছের আমে পাক ধরতেই জেলা জুড়ে আমসত্ত্ব তৈরির ধুম পড়ে যায়। জেলার অধিকাংশ বাড়িতেই তৈরি হয় আমসত্ত্ব। চলতি বছরও ব্যতিক্রম হয়নি। তবে এবারে আমসত্ত্ব তৈরির হিড়িক আরও বেড়ে গিয়েছে। ফলে শুরু থেকেই দাম না পাওয়ার হতাশায় ভুগতে শুরু করেছেন প্রস্তুতকারকেরা। তাঁদের দাবি, আমের মতোই আমসত্ত্বও বিদেশে পাঠাতে উদ্যোগ গ্রহণ করুক সরকার।
মালদহে ইতিউতি তাকালেই চোখে পড়ে আমের বাগান। জেলায় প্রায় সাড়ে তিরিশ হাজার হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়। আর উৎপাদন হয় গড়ে আড়াই থেকে তিন লক্ষ মেট্রিক টন। তবে এক দশক আগেও গাছের জীবন শক্তির কারণে এক বছর বেশি উৎপাদন হলে, পরের বছরেই কম উৎপাদন হত আম। তবে বাগানগুলিতে সেচের ব্যবস্থা উন্নতি এবং চাষিরা সচেতন হওয়ায় এখন প্রতি বছর গড়ে আম উৎপাদন হচ্ছে জেলায়। আর আমের উৎপাদন বাড়তেই বাড়ছে আমসত্ত্ব তৈরিও। ইংরেজবাজার ব্লকের কাজিগ্রাম, নরহাট্টা, কোতুয়ালি, রতুয়ার মহারাজপুর, পুখুরিয়া প্রভৃতি গ্রাম পঞ্চায়েত গুলিতে ঘুরলেই দেখা যায় মহল্লার পর মহল্লায় চলছে জোর কদমে আমসত্ত্ব তৈরি। আমসত্ত্ব তৈরির কাজ করেন বাড়ির মহিলারাই।
কাজিগ্রামের ডানকুনির বাসিন্দা সবিতা দাস বলেন, “আমাদের কোনও প্রশিক্ষণ হয়নি। আমরা শাশুড়ি কিংবা বৌদিদের কাছেই শিখেছি আমসত্ত্ব তৈরি। আমসত্ত্ব তৈরিতে প্রয়োজন পাকা রসালো মিষ্টি স্বাদের আম। যেমন গোপালভোগ, হিমসাগর, ল্যাংড়া, ফজলির মতো আম। গাছ পাকা সেই আমের খোসা কেটে নিয়ে রস বের করতে হয়। তারপর পরিস্কার কাপড় দিয়ে সেই রস ছেকে নেওয়া হয়য তারপরে কাপড়ে ঢেলে দেওয়া হয়। এমনই আমের রস তৈরি করে চার থেকে পাঁচবার দিতে হয়। আমসত্ত্ব তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজন চড়া রোদ। আবহাওয়া ভালো থাকলেই দ্রুত শুকোবে আমসত্ত্ব।” এবারে কত কুইন্টাল আমসত্ব দিবেন তিনি বলেন, “এবারে আমের উৎপাদন খুব হয়েছে। আর দামও নাগালের মধ্যে। সেই সঙ্গে আবহাওয়াও আমসত্বের পক্ষে অনুকূল। তাই আড়াই থেকে তিন কুইন্টাল আমসত্ত্ব তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ওই গ্রামেরই বাসিন্দা ইতিকা চৌধুরী বলেন, ‘‘জৈষ্ঠ্য মাসের শুরু অর্থাৎ গোপাল ভোগ আম বাজারে নামতেই আমরা আমসত্ত্ব তৈরির কাজে নেমে পড়ি। কারণ গোপাল ভোগ আমের আমসত্ত্ব মিষ্টি ও সুস্বাদু হয়।” আমসত্ত্ব তৈরিতে লাভের মুখ দেখতে পান? তিনি বলেন,
“হাজার টাকা কুইন্টাল দরে আম কিনতে হয়। আর এক কুইন্টাল আমে প্রায় সাড়ে তিন কেজি আমসত্ত্ব তৈরি হয়। তারপরে শ্রমিক খরচ এবং আমাদের পরিশ্রম রয়েছে।” তবে বাজারে উন্নতমানের আমসত্ত্ব প্রায় এক হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। তবে আপনাদের লাভ কেন হয় না? তারা বলেন, প্রায় ছমাসের বেশি আমসত্ত্ব রাখতে পারি না। তাই লোকসানের ভয়ে পাইকারেরা বাড়ি থেকে মাত্র তিনশো থেকে চারশো টাকা দামে আমসত্ত্ব কিনে নিয়ে যান। আর বাজারে তাঁরা বেশি দামে বিক্রি করেন।
ওই গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য মন্টু ইসলাম বলেন, আমাদের গ্রামের অর্থনীতি আমসত্ত্বের উপরেই নির্ভরশীল। শুধু আমাদের গ্রামেরই নয়, পুরো কাজিগ্রাম জুড়েই আমসত্ত্ব তৈরি হয়। তবে প্রস্তুতকারকেরা লাভের মুখ দেখতে পান না। কিছু পাইকার খুব সামান্য দামে তাঁদের কাছ থেকে আমসত্ত্ব কিনে নিয়ে যায়। তাই এবারে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে প্রশাসনের কাছে আমসত্ত্বের বিষয়টি জানানো হবে। সম্প্রতি কলকাতায় মেলায় ব্যাপক আমসত্ত্ব বিক্রি হয়েছে।
গত, মে মাসে মালদহ সফরে আসেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি মালদহের আম ইউরোপীয়ান দেশগুলিতে পাঠানোর আশ্বাস দিয়েছিলেন। তারপর থেকেই জেলা প্রশাসন আম বিদেশে পাঠাতে উদ্যোগী হয়। তাই আমের মতো আমসত্বও বিদেশে পাঠানোর দাবি তুলেছেন প্রস্তুতকারকেরা। প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে আমসত্ব নিয়ে বিদেশে পাঠানো হলে জেলার অর্থনীতির আমূল বদলে যাবে বলে জানান মালদহের ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জয়ন্ত কুণ্ডু।
উদ্যান পালন দফতর সহ অধিকর্তা রাহুল চক্রবতী বলেন, “কলকাতা, দিল্লি মেলায় আমের মতো আমসত্বও আমরা বিক্রি করি। বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।” এটি মালদহের ক্ষেত্রে খুবই গর্বের ব্যাপার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy