দুরন্ত ‘মে’ মাস। প্রতিভাবানদের সময়। ছায়ার মতো, মায়ার মতো। এক দিকে রবীন্দ্রনাথ গাইছি, অন্য দিকে নজরুল। ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়ার দিনও এই উনিশেই। শুরুর দিন, ১ মে আক্ষরিক অর্থেই লাল সূর্যের দিন।
১৯০৮ সাল। ১৯ মে জন্ম হল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বিহারের দুমকায়। পৈতৃক বাড়ি ঢাকা বিক্রমপুরের মানবদিয়া গ্রাম। নীরদাসুন্দরী ও হরিমাধব বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র। মেধাবী ছিলেন। কথাসাহিত্যের এক বিশেষ যুগ তৈরি করেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে পৃথিবী জুড়ে মানবিক মূল্যবোধের চরম সঙ্কটময় মুহূর্তে সাক্ষর রেখে যাওয়া ব্যক্তিত্ব মানিক।
বিচিত্রা পত্রিকায় ‘অতসী মামী’ নামে গল্পে তাঁর প্রকাশ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নামে। আসলে তিনি প্রবোধ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। জীবন জুড়ে দারিদ্র, অসুস্থতা তাঁর লেখাকে দুর্বল তো করেইনি বরং মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, নিয়তিবাদ, ফ্রয়েডিয় মনঃসমীক্ষণ আর মার্ক্সীয় শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্ব তাঁর লেখা গভীর ভাবে প্রভাবিত করে। সামান্য জীবনকালে লিখে ফেলেন পঞ্চাশটি উপন্যাস। প্রচুর কালজয়ী গল্প।
উল্লেখ করতেই হবে ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ বা ‘দিবারাত্রির কাব্য’র কথা। নিজেই দিবারাত্রির কাব্যের রূপকধর্মিতার কথা বলেছেন। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, সমাজতত্ত্ব ও পরিবেশের অমসৃণ মনস্তত্ত্ব আছে ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’য়। যেখানে ডাক্তার শশী দ্বন্দ্বের চরমতায় উচ্চারণ করে, “শরীর শরীর.. তোমার মন নাই কুসুম!” আমরা স্তব্ধ হই। অথবা ধরুন, ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসে কপিলা কুবেরের সম্পর্কে নদী পদ্মা ব্যাকগ্রাউন্ড। অসম্ভব সুন্দর রাতের নৌকোগুলির সারিবদ্ধ টিমটিমে আলোর বিন্দু, ধোঁয়া ধোঁয়া আকাশ আর নরনারীর কথা। এক কথায় অসাধারণ।
মানব-চরিত্রের দুরুহ মনঃস্তত্ত্ব বা তার বাইরে গিয়ে গল্প ধারায় দেখি, প্রাগৈতিহাসিক, ছোট বকুলপুরের যাত্রী, সরীসৃপ, হলুদ পোড়া, সিঁড়ি, শিল্পী বা পাশফেল-এর মতো গল্প।
ভাল ভাবে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরেও নীরেনের আত্মহত্যার পথ নেওয়া সবই পারিপার্শ্বিক সামাজিক শিক্ষাব্যবস্থার ভগ্ন অবস্থার দিকে আঙুল তোলে। আজও তা প্রাসঙ্গিক এ গল্প। ভবিষ্যতের অন্ধকারময়তা বর্তমান কলুষতা, শিক্ষায় পদাঘাত আর রক্তপাতের ছবি।
মানিক সর্বকালে প্রাসঙ্গিক। সাহিত্যে মনোযোগী হবেন বলেই মানিক চাকরি করেননি। অঙ্ক প্রিয় বিষয় হলেও গতানুগতিক পাশের পড়া শেষ করেননি। দরমার বেড়া আর কাঠের জীর্ণ পার্টিশনে নড়বড়ে চেয়ার-টেবিলেই একের পর এক রচিত হয়েছে অবিসংবাদী রচনা।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়, গীতা মুখোপাধ্যায়, অমল দাশগুপ্ত ভালবাসতেন। যোগাযোগ রেখেছেন শেষ পর্যন্ত। ভালবাসতেন গান। হারমোনিয়াম বাজিয়ে গেয়ে উঠতেন, ‘‘ওরে নীল যমুনার জল...’’। মৃগীরোগে অজ্ঞান হয়ে যেতেন। লিখতে না পারলেই কষ্ট পেতেন খুব। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ লেখার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেও শেষ করেন এ কালজয়ী উপন্যাস। মারাত্মক ব্লাড ডিসেন্ট্রিতে মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে, ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর চলে যান তিনি।
কথাসাহিত্যের তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম মানিক শ্রেণিসংগ্রামের ইতিবৃত্ত নিয়ে সাহিত্যের ধারাবাহিকতায় সূর্যের মতই ভাস্বর। আজ, ১৯ মে সত্যি অর্থেই তা-ই অক্ষরের স্বাধীনতার দিন।
অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা, জলপাইগুড়ি
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)