ভোট পর্ব মিটেছে। কিন্তু, এলাকা দখল নিয়ে নিউ জলপাইগুড়ি এলাকায় গোলমাল বেড়েই চলেছে। রাতে তো বটেই, দিনে-দুপুরেও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দু’দল একে অন্যকে হুমকি দিচ্ছে বলে পুলিশ খবর পেয়েছে। ইতিমধ্যে দুপক্ষের ৩ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তাতেও পরিস্থিতি ঠিক হয়নি। বুধবারও গোলমাল হয়েছে বিক্ষিপ্ত ভাবে। এনজেপি-র মতো বাণিজ্যিক এলাকার ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের অনেকেরই অভিযোগ, ভোটের ফল কী হতে পারে তা নিয়ে আশঙ্কার জেরেই ‘সিন্ডিকেট’-এর দখল নিতে মরিয়া তৃণমূলের যুযুধান দুটি গোষ্ঠী।
ফলে, ওই ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি বিধানসভার তৃণমূল প্রার্থী তথা বিদায়ী উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব শিবির ঘরে-বাইরে অস্বস্তিতে পড়েছেন। দলের অন্দরের খবর, গৌতমবাবু কেন বিরোধ সামলাতে পারছেন না, তা নিয়ে অবাক তৃণমূলের রাজ্য স্তরের অনেক নেতাই। কয়েক জন আবার একান্তে দাবি করছেন, ওই গোলমাল বজায় থাকলে কার কার বেশি লাভ, তা নিয়ে দলীয় পর্যায়ে তদন্ত হোক। বিরোধী বাম ও কংগ্রেস জোটের তরফে অনেকে অবশ্য দাবি করেছেন, এনজেপি এলাকায় তোলা আদায় বাবদ ফি মাসে যে ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ টাকা ওঠে তা কারা তুলে কী ভাবে ভাগ করছে, সেটা নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত।
এই অবস্থায়, এ দিন সকালে এনেজপি-র তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর নেতা প্রসেনজিৎ রায় এবং জয়দীপ নন্দীকে শিলিগুড়ির কলেজপাড়ার বাড়িতে ডেকে পাঠান গৌতমবাবু। দলীয় সূত্রের খবর, বৈঠকে গৌতমবাবু দুই নেতাকেই সতর্ক করে দিয়েছেন। আগামী দিনে গোলমাল এমন ভাবে চলতে থাকলে তিনি পুলিশকে কড়া ব্যবস্থা নিতে বলতে বাধ্য হবেন বলে জানিয়েছেন। পরে গৌতমবাবু বলেন, ‘‘এনজেপি এলাকার নেতা বিজন নন্দীর মৃত্যুর পর একটু সমস্যা হয়েছিল। পরে কমিটি গঠিত হয়েছে। সবাইকে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। কোর কমিটি রয়েছে। জেলার আইএনটিইউসি সভাপতি সেটা দেখছেন। নীতিগত সমস্যা নেই। মতভেদ হয়েছে মাত্র। দুই পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। আলোচনার মাধ্যে বিষয়টি মিটে যাবে।’’ এনজেপি-র সিন্ডিকেটের দখল, টাকা আদায়ের কর্তৃত্ব নিয়ে গোলমালের প্রসঙ্গে গৌতমবাবুর বক্তব্য, ‘‘এ সব আমার জানা নেই। কারা কী বলছেন জানি না।’’
অথচ গত রবিবার, ভোটের দিন রাত থেকে এনজেপি-তে যা চলছে, তাতে এলাকা দখলের চেষ্টা স্পষ্ট বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীরা। সেই রাতে একটি পার্টি অফিসে পেট্রোল বোমা মারার অভিযোগও উঠে। মঙ্গলবার রাতে সেখানে তৃণমূলের দুটি গোষ্ঠীর গোলমাল রাস্তায় নেমে আসে। দু’পক্ষ একে অন্যকে লক্ষ্য করে ধারালো অস্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে তেড়ে যায় বলেও অভিযোগ। মঙ্গলবার রাতে জয়দীপ নন্দী অভিযোগ করেন, তাঁকে খুন করার চক্রান্ত হয়েছে। তেমনিই, প্রসেনজিৎবাবুর দাবি, দল পদ দিলেও তাঁকে পছন্দ না হওয়ায় কেউ কেউ সমস্যা তৈরি করছেন বলে অভিযোগ করেন। এ দিন অবশ্য আলাদা ভাবে দু’জনই বলেছেন, ‘‘আলোচনার মাধ্যমে সব মেটানো হবে।’’ তৃণমূল সূত্রের খবর, বিজন নন্দীর মৃত্যুর পর এলাকায় কর্তৃত্ব নিয়ে তাঁর ভাই জয়দীপ এবং ছায়াসঙ্গী প্রসেনজিতের মধ্যে গোলমাল শুরু হয়। সেই সঙ্গে জয়দীপের পিছনে উঠে আসেন বিজন নন্দীর ছেলেও। শেষে দু’পক্ষকে নিয়ে বসে এনজেপি এলাকায় সমস্ত সংগঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রসেনজিৎকে। আর জয়দীপকে ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ির আইএনটিটিইউসি-র সভাপতি করা হয়। তাঁর দাদাও ওই পদে ছিলেন। তিক্ততা এমন পর্যায়ে পৌছায় যে, সকলে আলাদা আলাদা দফতর ঘুরে কাজ শুরু করেছেন। প্রসেনজিতের পিছনে অধিকাংশ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ছাড়াও দার্জিলিং জেলার বেশ কয়েক জন নেতা আছেন। তেমনিই জয়দীপের পাশে এ জেলা ছাড়াও জলপাইগুড়ি জেলার দুই নেতা আছেন। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
এলাকার দখলের জন্য দুই গোষ্ঠীই মরিয়া। ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, এনজেপি এলাকায় তৃণমূলের ২৬টি সংগঠন। চা, রিকশা, টোটো, কুলি, হকার, গাড়ি চালক-সহ বিভিন্ন স্তরের ওই সংগঠন তৈরি করে ‘ওয়েলফেয়ার ফান্ডের’ নামে রোজ টাকা তোলা হয়। সংগঠনের এজেন্টরা রোজ ১০ টাকা থেকে ১০০ টাকা করে তুলে তহবিলে জমা করেন। যার পরিমাণ মাসে কম করে ৩০ লক্ষ টাকা বলে সিন্ডিকেট সূত্রের খবর।
গৌতম দেবের বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন জয়দীপ নন্দী ও প্রসেনজিৎ রায়। — নিজস্ব চিত্র।
এর উপরে রয়েছে রেলের ঠিকাদারি। এনজেপি-তেই এই নিয়ে সিন্ডিকেটের তুমুল রমরমা। পশ্চিমে বিহারের পটনা, কিষানগঞ্জ এবং পুরে অসমে বিভিন্ন রেলের ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সিন্ডিকেটটি চলে। উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের কোনও কাজের বরাত বার হলেও কাজের টাকার উপর সিন্ডিকেট ‘ট্যাক্স’ হিসেবে ৩.৫ থেকে ৫ শতাংশ টাকা আদায় করে বলে অভিযোগ।
এনজেপি-তে রমরমা কাটা তেলের ব্যবসারও। ইন্ডিয়াল অয়েল কর্পোরেশনের ডিপো রয়েছে। সেখানে ট্যাঙ্কার থেকে তেল চুরির ঘটনা ঘটে। বাড়ির নীচে মাটির কুয়ো তৈরি করে লিটার লিটার তেল মজুত করে চোরা বাজারে ছাড়া হয়। কাগজপত্র বিহীন বিভিন্ন ট্যাঙ্কারেও সেই তেল উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হয়।
আর রয়েছে বেআইনি মদের ভাটি, ঠেক এবং দোকান। এ সব রয়েছে এনজেপি জুড়েই। কোনও কোনও এলাকায় রমরমা চোলাই থেকে জাল বিদেশি মদের। বিভিন্ন বাড়িতে সেই মদ সিকিম-সহ বিভিন্ন এলাকা থেকে এনে মজুত করা হয়। বিরোধীদের অনেকেরই অভিযোগ, প্রতি মাসের ওয়েলফেয়ার ফান্ড এবং মাসোহারার টাকা নেতাদের মাথা অবধি পৌছায়। অন্তত পাঁচ জন নেতার কাছে প্রতিমাসে মোটা টাকার প্যাকেট পৌঁছানোর দস্তুর রয়েছে। যার মধ্যে এক জন নেতার কাছে মাসে ৫ লক্ষ টাকা পাঠানো হয় বলে বিরোধীদের অনেকেই দাবি করেছেন।