Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

মেঘের মতো দামাল স্মৃতি

সারারাত ঘুমের মধ্যেও জলের শব্দ লেগে থাকতো আঠার মতো। এই বাড়িতেই পুজোর আসনে প্রথম পিতলের বেলপাতা দেখেছিলাম। বাইরের ঘরে যেতে বুক কেঁপে যেত। মেজ জ্যেঠুর শিকার করা বাঘ, হরিণ, চিতাবাঘ, সম্বর আরও কী কী সবের মাথা স্টাফ করা থাকতো।

সেবন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৭ ০২:৩৯
Share: Save:

শুধু বয়স বাড়লেই নয়, বর্তমানে আর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত মানুষও নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়। হঠাৎ বদলে যাওয়া পরিস্থিতির সঙ্গে সে খাপ খাওয়াতে পারে না। খণ্ড খণ্ড কুয়াশার মতো স্মৃতি মনে পড়ে।

তিন ধরিয়ার গল্প ঠাকুর্দা, ঠাকুমা, বাবার কাছে শুনতাম। আমার দৌড় ছিল কার্শিয়াং অবধি। মন্টিভিয়েট রোড়ে পাহাড়ের ঢালে যেন ক্লিপ দিয়ে আটকানো আধা কাঠের দোতলা বাড়ি। ‘শিখরবাস’ নামে সে বাড়ি ঠাকুমা শিখরবাসিনীর নামে বানিয়েছিলেন ঠাকুর্দা। তিনি ছিলেন তিন ধরিয়ার রেলবাবু। বাবার চাকরি সূত্রে আমরা শিলিগুড়িতে চলে আসি। জ্যেঠুরা থেকে যান ওই রেলে চাকরির সূত্রে। প্রায়ই বিনে পয়সায় টয়ট্রেন ধরে ঠাকুর্দার বগলদাবা হয়ে কার্শিয়াঙে চলে যেতাম। পথের দুই পাশে বেলুন ফুল (ওই নামেই জানতাম) ফরগট মি নটের নীল সাদা ঝাড়, কমলা-হলুদ ন্যাশটাশিয়াম। বারান্দা জুড়ে চৌক বড়ো টবে হরেক গোলাপ অ্যাজেলিয়া। নাক বরাবর ঢালওয়ালা উঠোনে বেঁটেমোটা ফল ধরে এমন শশার গাছ। ইশকুশ ঝুলে আছে সর্বত্র। ডানদিকে নীচে নামার আর একটি সিঁড়ি। এটি বেশ গা ছমছমে, শ্যাওলা ভরা। নেমেই পাহাড়ের খাদ বরাবর ম্যাগ্নোলিয়ার বড়ো সাদা পাপড়ির প্রাচীন ফুলের গাছ।

এক তলায় ছোট বেলায় এক সময় ভাড়া থাকতেন লেখিকা সমাজসেবী জয়া মিত্র। বাড়ির গা ঘেঁষে সীমানা নির্দেশক এক দুরন্ত ঝোরা। রাতেবিরেতে বড়দের কারও গামবুটে পা ঢুকিয়ে বাথরুমে যাওয়ার সময় ডানদিকে কাচ ঢাকা জানলা দিয়ে সেই ঝরনার উদ্দাম জলে চাঁদ নেমে আসতে দেখতাম। সারারাত ঘুমের মধ্যেও জলের শব্দ লেগে থাকতো আঠার মতো। এই বাড়িতেই পুজোর আসনে প্রথম পিতলের বেলপাতা দেখেছিলাম। বাইরের ঘরে যেতে বুক কেঁপে যেত। মেজ জ্যেঠুর শিকার করা বাঘ, হরিণ, চিতাবাঘ, সম্বর আরও কী কী সবের মাথা স্টাফ করা থাকতো। বড় জ্যেঠুর ঘরে সাহেবদের কাছ থেকে অকশনে কেনা ভিতরে পর্দা দেওয়া জমকালো কাঠের আলমারি, আর সার সার স্যুট। শ্বেত পাথরের গোল টেবিল। শিক ছাড়া জানলা খুলে দিলেই খাদে হুমড়ি খাওয়া ঘরে ডাকাতের মতো মেঘের দলবল ঢুকে পড়ত। বিছানায় সারা বছর পেতে রাখা কম্বল ভিজছে, আলনায় জ্যেঠিমার শাড়ি ভিজছে। এমন সাদা ঘন দুধের মতো মেঘ আগে দেখিনি কখনও। মাথায় ট্রাঙ্ক নিয়ে হৃদয়াকৃতি কেক আর পাঁউরুটি নিয়ে ঘুরতো বেকারির ফেরিওয়ালা। বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে পাগলাঝোরা, সকালে চড়াই ভাঙা নির্জন জলের রিজার্ভার দূরবীনদাঁড়া। শহরে বাইক, গাড়ি কিছুই ছিল না। ভারী পরিচ্ছন্ন আর নির্জন ছিল পথঘাট।

পাহাড়ে এমন বাড়ি আর আশপাশ জুড়ে ভূতের গল্প থাকবে না, তা কি হয়! কার্শিয়াঙের পথঘাট জুড়ে ছিল সাহেব ভূত, কুকুর ভূতের গল্প। বাবার কাছে শোনা লীলা দেশাই থেকে সুমিতা সান্যাল, দেবব্রত বিশ্বাস, নরেন দেব, রাধারানিদেবী বা ফজলুল হক বা শিবকুমার রাইয়ের কার্শিয়াং তার স্টেশন, রাজরাজেশ্বরী হল নিয়ে কোন স্মৃতির অতলে ডুবে গিয়েছে। হয়তো ফ্যাতাড়ুরা বা সেই সব ভূতেরা জ্যান্ত হয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে সেই কলোনিয়াল হোম। বসন্তে কার্সন রিপ অর্কিডে ছেয়ে যেত বলে লেপচারা তাদের গ্রামের নাম দিয়েছিলেন কার্শিয়াং বা খারসং। এখন সে ফুল আর সেই সব গল্প শুধু দোমড়ানো, চটকানো, ছিন্ন, শ্রীহীন।

সেই দামাল মেঘেদের মতোই স্মৃতিও এখনও হুমড়ি খেয়ে ঢোকে, কিন্তু এখন তাতে মন ভারী হয়ে আসে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE