দার্জিলিঙের রায় ভিলা। — নিজস্ব চিত্র
তাঁর প্রিয় শহর দার্জিলিঙে এসেছিলেন বেশ কয়েক বার। কখনও নিছক অবসর যাপন করতে ছুটে এসেছেন সমতল থেকে বহু দূরে এই দার্জিলিং পাহাড়ে, কখনও ‘কুইন অফ হিলস’-এর কোলটি হয়ে উঠেছিল তাঁর আরোগ্যের আশ্রয়স্থল। বিবেকানন্দের মানসকন্যা নিবেদিতা।
দার্জিলিঙে বসে চোখের আয়নায় পাহাড়ি প্রকৃতির মুগ্ধতা নিয়ে কোনও উইলসনকে লিখে জানালেন, ‘আমি কখনও জানতাম না দার্জিলিং এত সুন্দর! ঠিক এখনই বসন্তের ফুলে ভর্তি।’ (আই নেভার নিউ দ্যাট দার্জিলিং ওয়াজ সো বিউটিফুল অফ অটাম ফ্লাওয়ার)।
দার্জিলিঙের বৈচিত্র্যময় পাহাড়ি প্রকৃতির মতোই তাঁর কাজের যে বহুমুখী প্রকাশ ছড়িয়ে আছে পাহাড়ি পথের বাঁকে বাঁকে, তাও তো অসামান্য বৈচিত্র্যে ভরপুর। দার্জিলিঙের দিনগুলিতে কর্মব্যস্ততার মধ্যে ডুবিয়ে রাখতেন নিজেকে। কখনও বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার জন্য দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে সঙ্গে নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন, কখনও বা জগদীশচন্দ্র বসুর গবেষণা গ্রন্থের প্রুফ সংশোধন করছেন। ছুটে যাচ্ছেন শৈল শহরে বস্তিবাসী শিশুদের কাছে, আবার কখনও বা আপন খেয়ালে ঘুরে বেড়াতেন আশপাশের পাহাড়ি গ্রামগুলিতে, প্রত্যক্ষ করেছেন গ্রামীণ জীবন। তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল সেখানকার জনজাতির মানুষ। মিশেছিলেন নেপালি ভুটিয়া স্থানীয় অদিবাসীদের সঙ্গে। তাঁর অভিজ্ঞতা, ‘এরা সকলেই সাহসী, পরিশ্রমী আর ধর্মপ্রাণ।’
১৮৯৮-র এপ্রিল মাস। বিবেকানন্দ তখন দার্জিলিঙে। মিস মুলারের সঙ্গে দার্জিলিং যাওয়ার কথা নিবেদিতারও। স্বামীজী হঠাৎ তাঁকে টেলিগ্রাম করে আসতে নিষেধ করলেন।
প্রথম বার দার্জিলিঙে যাওয়ার সুযোগ এল ১৯০৩ সালের মে মাসে। তাঁর ঠিকানা হল ঘুম স্টেশনের কাছে ‘অ্যাসাইলিন ভিলা’। কিছু দিন আগেই এখানে এসে পৌঁছেছেন সস্ত্রীক জগদীশচন্দ্র বসু। আছেন নিবেদিতার কিছু পরিচিত জন, বন্ধুরাও। তাঁদের সঙ্গে দেখা হবে না তাও কি হয়? সকলেই চলে আসতেন তাঁর বাড়িতে।
এ বারে এসে ছিলেন ৪৯ দিন। মাঝে এক দিন তাঁর বাড়িতে এসে উপস্থিত গোপালকৃষ্ণ গোখলে। তিনিও তখন দার্জিলিঙে। বড়দিনে স্কুল ছুটি থাকবে। সেই সময় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ১৯তম অধিবেশন বসবে মাদ্রাজে। নিবেদিতার কাছে জানতে চাইলেন ‘আপনি যাচ্ছেন তো?’ তাঁর কৌতূহলী জিজ্ঞাসা ‘আপনি কংগ্রেস থেকে দূরে সরে আছেন কেন?’ আশ্বস্ত করলেন নিবেদিতা। জানালেন, ‘কংগ্রেসে সক্রিয় যোগদান না করলেও বিশ্বাস করুন কংগ্রেস আমার চিন্তার বাইরে নয়।’ সে বছরই অগস্টের মাঝামাঝি বসু-দম্পতির সঙ্গে চলে এলেন দার্জিলিঙে। সেখানে জগদীশচন্দ্রের গবেষণাপত্র তৈরির কাজে বাড়িয়ে দিলেন সাহায্যের হাত। পাশাপাশি চলল নিজের দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘ওয়েব অব ইন্ডিয়ান লাইফ’-এর পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতির কাজও। এ বারে এসে দার্জিলিঙে বসেই শেষ করলেন বইটির ছ’টি অধ্যায়ের কাজ।
এ সবের ফাঁকেই চলে যেতেন বস্তিবাসীদের কাছে। সেখানে শিশুদের হাতে হাতে তুলে দিতেন খেলনা।
১৯০৫-র মার্চে হঠাৎই ‘ব্রেন ফিভার’-এ আক্রান্ত হলেন নিবেদিতা। দীর্ঘ এক মাসের জ্বরে শরীরের অবস্থা সঙ্গিন। কিছুটা সুস্থ হলে ডাক্তার নীলরতন সরকারের পরামর্শে জগদীশচন্দ্র হাওয়া বদল করতে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে নিবেদিতাকে নিয়ে পাড়ি দিলেন দার্জিলিং। এ বারে তাঁদের সঙ্গী হলেন নিবেদিতার বোন ক্রিস্টিন। সেখানে বসু-দম্পতি আর ক্রিস্টিনের সেবাযত্নে ধীরে ধীরে সুস্থ হতে লাগলেন। নিবেদিতাকে মানসিক ভাবে প্রফুল্ল রাখার জন্য জগদীশচন্দ্র সব সময় তৎপর। একদিন দার্জিলিঙের বাজারে গিয়ে দেখলেন একজন একটি শেয়ালছানা নিয়ে এসেছে বিক্রির জন্য। জগদীশচন্দ্র চার আনা দিয়ে সেই শেয়ালছানাটিকে কিনে নিলেন। বাড়িতে ফিরে নিবেদিতাকে দিলেন।
নিবেদিতার কি আনন্দ এমন উপহার পেয়ে। তার নাম দিলেন ওয়াইল্ড হার্ট। তাকে নিয়েই সময় কাটাতেন, মেতে থাকতেন। শেয়ালছানাকে কেন্দ্র করে এ সব দেখে ঠাট্টার ছলে জগদীশচন্দ্র বললেন, ‘ওটার ওপর অত মনোযোগ দিলে তো মুশকিল। ও-ই দেখছি আমায় ফতুর করবে?’ একদিন সকালে নিবেদিতার গলায় অভিমানের সুর—‘কাজ করতে পারব এ বার।...আজ বিকেলে শেয়ালছানাটিকে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসব।’
১৯০৫-এর ১৬ অক্টোবর বঙ্গবিভাজন ঘোষিত হল। প্রতিবাদে কলকাতা-সহ সমগ্র দেশ উত্তাল। কলকাতার পথেঘাটে হিন্দু-মুসলিম সর্বস্তরে পালিত হল রাখিবন্ধন। নেতৃত্ব দিলেন রবীন্দ্রনাথ। নিবেদিতা তখন দার্জিলিঙে। সেখানেই ইংরেজ সরকারের বঙ্গভঙ্গের চক্রান্তের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে টাউন হলের জনসভায় বক্তৃতা মঞ্চে হাজির হলেন। সঙ্গে তাঁর দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। সে দিনের সভায় বললেন, ‘ধিক আমার জন্মভূমিকে। বাংলার বুকে এই যে ভেদের প্রাচীর তুলে সে দেশকে অপমান করেছে, ভারতবাসীর শৌর্য আর আত্মত্যাগ যত দিন তাকে তা তুলে নিতে বাধ্য না করে, আমরা চালিয়ে যাবই এ সংগ্রাম।’
দার্জিলিঙে দেশবন্ধু ও নিবেদিতার সাক্ষাতের একটি চমকপ্রদ গল্প আছে।
(ক্রমশ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy