Advertisement
০৩ মে ২০২৪

নাবালিকাকে টানা ধর্ষণ

আবার শিরোনামে ধূপগুড়ি। আবার নারী নির্যাতনের অভিযোগ। আবার অভিযুক্ত তৃণমূল। এবং তাদের আড়াল করতে পুলিশের একাংশের আসরে নেমে পড়ার অভিযোগ।

থানার পথে নির্যাতিতা ও তার পরিবার। শুক্রবার তোলা নিজস্ব চিত্র।

থানার পথে নির্যাতিতা ও তার পরিবার। শুক্রবার তোলা নিজস্ব চিত্র।

রাজকুমার মোদক
ধূপগুড়ি শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:০৬
Share: Save:

আবার শিরোনামে ধূপগুড়ি।

আবার নারী নির্যাতনের অভিযোগ।

আবার অভিযুক্ত তৃণমূল।

এবং তাদের আড়াল করতে পুলিশের একাংশের আসরে নেমে পড়ার অভিযোগ।

এ বার বিয়ের টোপ দিয়ে এক নাবালিকাকে বাড়িতে আটকে আট দিন ধরে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে ধূপগুড়িতে। সেই মামলা রুজু করতে নির্যাতিতা মেয়েকে নিয়ে দু’দিন ধরে থানায়-থানায় ঘুরে বেড়াতে হল মা-কে। নির্যাতিতার পরিবারকে হয়রানির অভিযোগ উঠল পুলিশের কয়েক জনের বিরুদ্ধে। শেষে পুলিশের এক বড় কর্তা খবর পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করার পরে টনক নড়ে জেলা পুলিশ কর্তৃপক্ষের। ধূপগুড়ির ওসি নির্যাতিতাকে মেডিক্যাল পরীক্ষা করাতে পাঠান ও অভিযোগ নেন।

বছর দুয়েক আগে সালিশি সভায় বাবাকে মারধরের প্রতিবাদ করায় দশম শ্রেণির ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ উঠেছিল। সেই মামলায় অভিযোগের তির ছিল তৃণমূল নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। ছাত্রীর বাবার অভিযোগ গ্রহণ করা থেকে মামলার তদন্ত— সবেতেই পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তা এবং পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ওঠে। তার পরে বারবার ধূপগুড়িতেই ছাত্রী খুন, পরীক্ষার্থীকে গাছে বেঁধে ‘রেপ’ করিয়ে দেওয়ার হুমকি, বাড়ি ঢুকে যুবতীকে দাদার সামনে ধর্ষণের চেষ্টার মতো একের পর এক অভিযোগ উঠেছে। প্রতি ক্ষেত্রেই অভিযুক্তরা কোনও না কোনও ভাবে শাসকদলের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এবং প্রতি ক্ষেত্রেই ধূপগুড়ি থানার বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ ওঠে। বুধবারের ঘটনাতেও অভিযুক্তরা সকলেই তৃণমূলকর্মী বলে পরিচিত। মূল অভিযুক্ত এলাকার এক প্রভাবশালী তৃণমূল নেতার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত হওয়ায় অভিযোগ না নিয়ে দু’দিন ধরে নাবালিকার মা-কে বানারহাট এবং ধূপগুড়ি, দুই থানা থেকে একাধিকবার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে শাসক দলের অন্দরেই অভিযোগ উঠেছে।

নির্যাতিতার মা-ও নিজেকে তৃণমূল কর্মী বলে দাবি করেছেন। এ দিন অভিযোগ গ্রহণের পরেও তার প্রতিলিপি দেওয়া হচ্ছিল না বলে অভিযোগ। শেষে এলাকারই আর এক তৃণমূল নেতা, যিনি ওই প্রভাবশালী নেতার বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর বলে পরিচিত, তিনি থানায় গেলে ওই প্রতিলিপি নির্যাতিতার মাকে দেয় পুলিশ। তবে যে থানা থেকে বারবার নির্যাতিত নাবালিকার মাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে, অভিযোগ লঘু করে করে আনতে বলা হয়েছে, সেই থানার পুলিশ আদৌও নিরপেক্ষ তদন্ত করবে কি না, সে প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে ধূপগুড়ির বাসিন্দাদের মধ্যে।

ধূপগুড়ি শহর লাগোয়া এলাকার বাসিন্দা ওই নাবালিকা গত ১৯ এপ্রিল থেকে নিখোঁজ হয়ে যায় বলে অভিযোগ। পুলিশকে মৌখিক ভাবে জানিয়েছিলেন নাবালিকার মা। গত মঙ্গলবার রাতে নাবালিকা পালিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। নাবালিকার অভিযোগ, ‘‘বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। তার পর থেকে বাড়িতে আটকে রেখে অত্যাচার শুরু হয়।’’ খলাইগ্রামের বাসিন্দা শাহরুখ আলম ফুঁসলে তাকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখে বলে অভিযোগ। মারধর করে, ভয় দেখিয়ে আট দিনে একাধিকবার তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ। বাড়ি ফেরার কথা বললে শাহরুখের ভাই-সহ আত্মীয়রা নাবালিকাকে মারধর করত বলে অভিযোগ। গত মঙ্গলবার রাতে অভিযুক্তদের কেউ বাড়িতে না থাকার সুযোগে নাবালিকা পালিয়ে আসে। এর পরেই অভিযোগ দায়ের করা নিয়ে টানাপড়েনের শুরু।

গত বুধবার সকালে নাবালিকাকে নিয়ে মা বানারহাট থানায় যান। নির্যাতিতার বাড়ি থেকে বানারহাট থানার দূরত্ব বেশি নয়। অভিযোগ, ঘটনাটি তাদের এলাকার নয় বলে বানারহাট থানা তাঁদের ফিরিয়ে দেয়। এর পর নির্যাতিতাকে নিয়ে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরের ধূপগুড়ি থানায় পৌঁছন মা। অভিযুক্তদের নাম শুনেই ধূপগুড়ি থানার অফিসারদের একাংশ নির্যাতিতার মা-কে অপেক্ষা করতে বলে। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় ৬ ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয় বলে অভিযোগ। সন্ধ্যার পরে থানা থেকে অভিযোগ বদলে নিয়ে আসতে বলা হয় বলে দাবি। নির্যাতিতার মায়ের অভিযোগ, ‘‘থানার কয়েক জন অফিসার আমাকে বলেন, ধর্ষণের কথা উল্লেখ থাকলে মেয়ের বদনাম হবে। শুধু মারধর করার অভিযোগ লিখে নিয়ে পরের দিন যেতে বলা হয়।’’ এ দিনও সকাল থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধূপগুড়ি থানায় বসিয়ে রাখা হয় মহিলা এবং নির্যাতিতাকে। অভিযোগ নিলেও তার কোনও প্রতিলিপি দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। পরে বিকেলে তৃণমূলের একটি গোষ্ঠীর নেতা অশোক বর্মন খবর পেয়ে আসরে নামেন। অশোকবাবু পুলিশকে জানান, তাঁদের দলের কেউ জড়িত থাকলেও ব্যবস্থা নিতে হবে। তখন পুলিশ প্রতিলিপি দেয়। জলপাইগুড়ির এসপি আকাশ মেঘারিয়া বলেন, ‘‘অভিযোগ নেওয়া হয়েছে। সব খতিয়ে দেখব।’’

পুলিশের দাবি, অভিযুক্ত পলাতক। অভিযুক্ত এবং তার পরিবার জেলা তৃণমূলের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক গুড্ডু সিংহের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। গুড্ডু সিংহ অভিযুক্তদের পরিবারের সদস্যদের চেনেন বলে মেনেও নেন। তবে একই সঙ্গে দাবি করেন, ‘‘এর পিছনে কোনও রাজনীতি থাকতে পারে না। কেউ অন্যায় করলে পুলিশ পদক্ষেপ করবে। আমি বা আমরা পুলিশকে প্রভাবিত করি না।’’

তবে গুড্ডুবাবুর অনুগামীদের একাংশের কার্যকলাপে দলের অন্দরেই যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে, এ দিন তা স্পষ্ট হয়ে যায়। অশোকবাবু স্বভাবতই ঘটনার সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগ নেই বলে দাবি করেছেন। তাঁর দাবি, ‘‘অভিযোগ নিয়েও প্রতিলিপি দেওয়া হচ্ছে না শুনে থানায় গিয়েছিলাম। রাজনীতির কোনও যোগ নেই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dhupguri rape TMC leader
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE