Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

টাকা দিয়ে দোষ চাপা দেওয়ার চেষ্টা

বন্ধ ঘরে দুই নাবালকের পুড়ে মৃত্যুর দায় এড়াতে সচেষ্ট হয়েছেন কিছু ব্যবসায়ী। সোমবার রাতে সেবক রোডের একটি দোকানে দুই শিশু শ্রমিকের মৃত্যু হয়। সে দিন তাদের পরিচয় পর্যন্ত জানা যায়নি। মঙ্গলবার তাদের বাড়ির লোক এসেছেন। কিন্তু পুলিশ সে কথা শিশু সুরক্ষা কমিটি বা চাইল্ড লাইনকে জানায়নি বলে অভিযোগ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:১৩
Share: Save:

বন্ধ ঘরে দুই নাবালকের পুড়ে মৃত্যুর দায় এড়াতে সচেষ্ট হয়েছেন কিছু ব্যবসায়ী।

সোমবার রাতে সেবক রোডের একটি দোকানে দুই শিশু শ্রমিকের মৃত্যু হয়। সে দিন তাদের পরিচয় পর্যন্ত জানা যায়নি। মঙ্গলবার তাদের বাড়ির লোক এসেছেন। কিন্তু পুলিশ সে কথা শিশু সুরক্ষা কমিটি বা চাইল্ড লাইনকে জানায়নি বলে অভিযোগ।

অভিযোগ উঠেছে, টাকার বিনিময়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ারই চেষ্টা চলছে। চেষ্টা হচ্ছে ওই দুই নাবালকের বয়স ভাঁড়িয়ে তাদের প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে দেখানোর। তারা ওই দোকানে কাজ করত না, এমন তথ্য প্রতিষ্ঠা করারও চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। শিশু সুরক্ষা কমিটির সদস্য দেবাশিস চন্দ বলেন, ‘‘মৃতদের পরিবারের লোকেরা এসেছে বলে কোনও খবর পুলিশ দেয়নি। আমাদের কাছে অভিযোগ পৌঁছেছে, অত্যন্ত গরিব পরিবারের বাসিন্দা মৃতের অভিভাবকদের অভিযুক্তের পক্ষে লোকজন বোঝাচ্ছে যে, তাদের কথা মতো বয়স এবং অন্য তথ্য দিলে অন্তত এক লক্ষ টাকা করে মিলবে।’’

এ দিন বিহার থেকে মৃত দুই বালকের পরিবারের লোকেরা মর্গে দেহ সনাক্ত করতে এলে স্থানীয় কিছু লোকজন গিয়ে তাঁদের ওই টাকার টোপ দেয় বলে দেবাশিসবাবু জানতে পেরেছেন। চাইল্ড লাইনের দায়িত্বে থাকা শেখর সাহা বলেন, ‘‘মৃতেরা যে এলাকার বাসিন্দা, সেখানে আমাদের বিহারের সদস্যেরা গিয়ে তাদের বয়সের নথি খতিয়ে দেখবে।’’

তবে পুলিশ এই সব অভিযোগই অস্বীকার করেছে। কিন্তু শিশু সুরক্ষা কমিটির কিছু সদস্যের মতে, টাকার টোপ ও নানা চাপে ওই দুই নাবালকের বাড়ির লোকজনও অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছেন। তাঁরা ওই দুই নাবালকের বয়স এক এক বার এক এক রকম বলেছেন। এমনকী, তারা শিলিগুড়িতে বেড়াতে এসেছিল না কাজ করতে এসেছিল, তা নিয়েও দু’রকম তথ্য দিয়েছেন তাঁরা।

শিশু সুরক্ষা কমিটি ও চাইল্ড লাইনের এক কর্মী এ দিন ওই নাবালকদের পরিবারের লোকজনের শিলিগুড়িতে আসার খবর পেয়ে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেডে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি সেখানে গিয়ে যা তথ্য পেয়েছেন, তা পুলিশের নথি থেকে ভিন্ন।

পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত করা হয়েছে, মৃত দুই শিশুর নাম সরবন মাঝি এবং রাজা পাসোয়ান।

সরবনের মায়ের কথা মতো তার বয়স আঠেরো বছর। বাড়ি বিহারের বৈশালী জেলার হুসেনাপুর গ্রামে। রাজার বয়স তার বাবা দীনেশবাবুর কথা মতো, সতেরো। বাড়ি হুসেনপুর লাগোয়া মজফ্ফরপুর জেলার দেহুলি গ্রামে। দেহলিতেই বাড়ি রাধেশ্যাম মাহাতোর। যে হোটেলে বন্ধ হয়ে পুড়ে মারা গিয়েছে ওই দুই বালক, তারই মালিক রাধেশ্যামবাবু। এ দিনও তাঁর খোঁজ পায়নি পুলিশ। বাড়ির লোকেরা পুলিশকে জানিয়েছেন, ওই দুই নাবালক হোটেলে কাজ করত না, তারা বেড়াতে শিলিগুড়ি এসেছিল।

পুলিশের সামনে সরবনের মা মোনাকিয়াদেবীও বলেন, তিন দিন আগে সরবন বিহার থেকে বেড়াতে এসেছিল শিলিগুড়িতে। পরে শিশু সুরক্ষা কমিটির লোকেরা জেরা করলে সরবনের বাবা মঞ্জুবাবু বলেন, ছেলের বয়েস চোদ্দ, পনেরো হবে। মাস খানেক আগে সে শিলিগুড়ি এসেছিল। পরে আবার তিনি-ই বলেছেন, ছয়, সাত মাস আগে ছেলে শিলিগুড়ি এসেছিল। যেখানে কাজ করত, ওই দোকানের মালিক মাসে কখনও দেড় হাজার, কখনও দু’হাজার বা তার কম টাকা পাঠাতেন।

তবে মোনাকিয়াদেবী, মঞ্জুবাবুদের সঙ্গে তাঁদের গ্রামের লোকজনও কয়েকজন এসেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, সরবন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছিল। তাঁদের মতে, রাজা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত। কিন্তু এ দিন খালপাড়া ফাঁড়িতে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলতে গেলে পুলিশ নিষেধ করেছে। তাঁদের পক্ষে এক আইনজীবী বলছেন, বেশি কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না, সমস্যা হবে।

সব দেখে মৃত দুই বালকের বয়স ভাঁড়াতে নানা চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ শিশু সুরক্ষা কমিটির। পুলিশ ও অভিযুক্ত পক্ষের লোকজনদের চাপেই বাড়ির লোকরা অসংলগ্ন কথা বলছে বলে শিশু সুরক্ষা কমিটির সদস্যদের একাংশ মনে করছেন। তাঁদের তরফে বিষয়টি জেলাশাসককে জানানো হয়েছে।

দোকান মালিক পলাতক রাধেশ্যাম তাঁর গ্রাম দেহুলি এবং লাগোয়া হুসেনাপুর থেকে এই দুই বালককে দোকানে কাজ করাতে এনেছিলেন বলে অভিযোগ। অভিযোগ, সোমবার রাতে হোটেলে তারা ঘুমোলেও মলিক বাইরে থেকে তালা দিয়ে চলে যায়। গভীর রাতে দোকানে আগুন লেগে ওই দুই শিশু জীবন্ত পুড়ে মারা যায়। ঘটনাটি নিয়ে হইচই হওয়ার পরে ময়দানে নামে শিশু কল্যাণ কমিটি, শিশু সুরক্ষা আধিকারিকের দফতর, চাইল্ড লাইন। সেই থেকে মৃতদের বয়স লুকোনোর চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ। পুলিশের একাংশ তাতে মদত দিচ্ছে বলেও অভিযোগ তুলেছেন শিশু সুরক্ষা কমিটির সদস্যদের একাংশ। এমনকী তাঁরা বিষয়টি নিয়ে থানায় যোগাযোগ করলে, কথা বলতে গেলে তাঁদের সম্মান করা হচ্ছে না, তথ্য দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ।

তাঁরা জানাচ্ছেন, নানা চাপে পড়ে ওই দুই নাবালকের বাড়ির লোকজন এতটাই বিভ্রান্ত যে, সরবনের বাবা বেঁচে আছেন কি না, সেই প্রশ্নেও তাঁরা ভুল তথ্য দিয়েছেন। মোনাকিয়াদেবীর কথা শুনে পুলিশ জানিয়েছিল, সরবনের বাবা মঞ্জু মাঝি মৃত। কিন্তু পরে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালের মর্গে গিয়ে দেখা যায় সেখানে হাজির মঞ্জুবাবু। মঞ্জুবাবু বলেন, ‘‘ভাটায় শ্রমিকের কাজ করি। লেখাপড়া জানি না। ছেলে মাস ছয়েক, সাতেক আগে শিলিগুড়িতে এসেছিল। কাজ করত। মাসে মাসে টাকাও পেতাম।’’

জেলা প্রশাসনের নির্দেশ পেয়ে এ দিন তাদের সঙ্গে কথা বলতে যান রাজগঞ্জের বিডিও এবং একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তাঁদের কাছে জানানো হয় সরবনের বয়স আঠেরো, রাজার বয়স সতেরো বছর। পরে শিশু সুরক্ষা কমিটির সদস্য দেবাশিসবাবু গিয়ে কথা বলেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE