মাউন্ট এভারেস্ট হোটেল এখন। ছবি দু’টি তুলেছেন রবিন রাই।
মহম্মদ আলি জিন্না, দেব আনন্দ, দিলীপ কুমার। অমিতাভ বচ্চন, রাজেশ খান্না।
কোনও একটি সূত্রে এক বন্ধনীতে রাখা যায় এঁদের সকলকে। সেই বন্ধনী ঐতিহ্যের। সেই বন্ধনী রয়েছে আমাদের রাজ্যেই। ‘কুইন অফ হিলস’ দার্জিলিঙে। শৈলশহরের মাউন্ট এভারেস্ট হোটেলে এসে কোনও না কোনও সময় থেকেছেন এঁরা সকলেই। সেই মাউন্ট এভারেস্ট হোটেলই বিক্রি হয়ে গেল সম্প্রতি।
হোটেল বিক্রির খবর প্রকাশ্যে আসতেই দার্জিলিংপ্রেমীদের মনে ভিড় করে আসছে নস্ট্যালজিয়া। আশির দশকের শেষ থেকে হোটেলটি বন্ধ। মালিকানার হাতবদলের সঙ্গে সঙ্গেই হোটেলটি নতুন ভাবে খোলার জল্পনাও শুরু হয়েছে। যদিও, নতুন মালিকানা সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে, ওই ভবনে হোটেল চালানো কতটা লাভজনক হবে তা খতিয়ে দেখিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। চার অংশীদার মিলে ওয়েবর গোষ্ঠীর থেকে হোটেলটি কিনেছেন বলে জানা গিয়েছে। বুধবার কলকাতায় দুই সংস্থার মধ্যে চুক্তি সই হয়েছে। হোটেলটি মোট চার একর জায়গা জুড়ে রয়েছে। ১১ কোটি টাকায় হোটেলটি বিক্রি হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
১৯১৪ সালে হোটেলটি তৈরি হয়। ১৯১৭ সালে এই হোটেলে এসে ছিলেন জিন্না। স্বাধীনতার পরে হোটলেটি ‘ওবেরয়’ গোষ্ঠীর মালিকানায় আসে। মূলত সে সময় থেকেই বলিউড তারকাদের গন্তব্য ছিল এই হোটেল। ওবেরয় গোষ্ঠীর হাতে আসার আগে হোটেলটির নাম ছিল ‘দার্জিলিং ফ্যামিলি হোটেল।’ ১৯৫০ সালে ওবেরয় গোষ্ঠী হোটেলটি পুরোপুরি কিনে নেয়। নামবদলও হয় তখনই। নানা সাহিত্যে একাধিকবার উঠে এসেছে এই হোটেলের কথা। অ্যালান স্যলির ‘দ্য এভারেষ্ট হোটেল’ নামে নভেল বিখ্যাত। সত্যজিৎ রায়ের যে দু’টি ফেলুদা-কাহিনী দার্জিলিঙের পটভূমিতে, সেই দু’টিতেই মাউন্ট এভারেস্ট হোটেলের কথা রয়েছে।
দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় তিনতলা হোটেলের জানলা-দরজা ঝুলে পড়তে শুরু করেছে। শ্যাওলা ধরেছে দেওয়ালে। ভিতর ঝুলে ভরেছে। কীটপতঙ্গেরর বাসা ঘরগুলিতে। ১৯৭৮ সালে আগুনে হোটেলের ৩০টি ঘর পুড়ে যায়। সেই ঘরগুলি বন্ধ রেখেই বাকি অংশ চলতে থাকে। তারপর থেকেই হোটেল ধীরে ধীরে বন্ধ হতে শুরু করে। তার বছর কয়েক পরে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হোটেলটি বন্ধ হলেও, আর খোলেনি। এখন ভগ্নপ্রায় দার্জিলিঙের গাঁধী রোডের তিন তলা এই হোটলেই কয়েক দশকের আভিজাত্য, গ্ল্যামারের রূপোলি ছটার স্মৃতি এখনও রয়ে গিয়েছে অনেকের কাছে।
১৯৭৫ সালে হোটেলের ডবল বেডরুমের ভাড়া ছিল ১১৫ টাকা, যা সেই সময়ে দার্জিলিঙের হোটেলগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি। হিন্দি ছবি ‘দো আনজানে’র বেশ কিছু দৃশ্য দার্জিলিঙে শ্যুটিং হয়েছে। সেই দৃশ্যগুলিতে ছিল অমিতাভ বচ্চনের। সে সময়ে অমিতাভ এসে এই হোটেলেই উঠেছিলেন। দেব আনন্দ, দিলীপ কুমার, আশা পারেখ, রাজেশ খান্না-র মতো তারকারাও দার্জিলিঙে শ্যুটিং বা ঘুরতে এলে এই হোটেলেই উঠতেন বলে জানা যায়। তারকারা এলে প্রতি সন্ধ্যায় হোটেলের লনে পার্টি হত। সেই সময়কার নানা ঘটনা এখনও প্রবীণ চিত্রগ্রাহক অর্জুন প্রধানের মনে রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘হোটেলের লনে মাঝেমধ্যেই নানা অনুষ্ঠান চলত। সেই সব অনুষ্ঠানে বিশিষ্টরা উপস্থিত থাকবেন। একবার দেব আনন্দ আমার ছবি দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন। আমাকে মুম্বই নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।’’
গত বুধবার কলকাতায় হোটেলের মালিকানা বদলের ঘোষণা হয়েছে। যে সংস্থা হোটেলটি কিনেছে তাদের অন্যতম অংশীদার ব্রিজমোহন গর্গ দার্জিলিঙেরই পরিচিত শিল্পপতি। তিনি বলেন, ‘‘সবকিছু এখন একেবারেই প্রাথমিক স্তরে রয়েছে। আর্কিটেক্ট, ইঞ্জিনিয়ারদের পরামর্শ নিতে হবে। তবে এতটুকু বলতে পারি, সংস্কার করে হোটেল চালানো লাভজনক হবে কি না খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’ তবে দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকা হোটেলের মালিকানা বদলের খবর পেয়ে অনেকেই উৎসাহী হয়ে পড়েছেন।
ট্যুর অপারেটর সুরেশ পেরিয়ালের কথায়, ‘‘আমি যখন ব্যবসা শুরু করেছিলাম, তখন এই হোটেল-ই ছিল সবচেয়ে অভিজাত। আমার হাত দিয়েই বলিউড তারকা থেকে শিল্পপতি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের বুকিং হতো।’’ ট্যুর অপারেটর থেকে বাসিন্দারা সকলেই এখন হোটেলের পুনরুজ্জীবনের অপেক্ষায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy