আচমকা ৫০০ টাকা ও ১০০০ টাকার চলতি নোট বাতিল হতেই একযোগে আতঙ্ক ও বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকাতেও। রাতে কেন্দ্রের তরফে ঘোষণার পরেই উদ্বিগ্ন হয়ে অনেকেই রাস্তায় নেমে পড়েন। সকলেরই লক্ষ্য, যত দ্রুত সম্ভব এটিএমে গিয়ে কিছু ১০০ টাকার নোট সংগ্রহ করা। কারণ, আজ, বুধবার থেকে দৈনন্দিন খরচ চালানোর মতো ১০০ টাকা নেই অনেকের কাছে। তাতেই তাঁরা আতঙ্কিত। অনেকে আবার বিভ্রান্তও। দার্জিলিং, কার্শিয়াং, কালিম্পং, সিকিমে থাকা পর্যটকেরা অনেকেই বুঝতে পারছেন না কী ভাবে দুদিন চলবে! কারণ, তাঁদের অনেকের কাছেই ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট রয়েছে। উপরন্তু, পেট্রোল পাম্পে তেল নেওয়ার জন্যও নগদ টাকা দরকার। সেটাই বা কী ভাবে যোগানো যাবে তা নিয়েই বিভ্রান্ত তাঁরা অনেকেই।
পর্যটন প্রসারে যুক্ত রাজ বসু গোটা ঘটনাকে অনভিপ্রেত বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘হাসপাতাল, নানা ক্ষেত্রের টিকিট কাটায় ছাড় দিলেও কেন পর্যটকদের ছাড় দেওয়া হল না! এতে কী যে সমস্যা হবে তা বলে বোঝানো যাবে না।’’ ইস্টার্ন হিমালয়ান ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের কার্যকরী সভাপতি সম্রাট সান্যাল ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘একটা নোটিস দেওয়া উচিত ছিল। পাহাড়ের প্রত্যন্ত এলাকায় যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা সকালে উঠে খাবারের বিল দিতে না পারলে কী হবে! তাঁদের টাকা পাঠানোও তো যাবে না। বিদেশের পর্যটকদের কাছে কী বার্তা যাবে!’’
আবার সাধারণ মানুষও সমস্যা পড়েছেন। যেমন বালুরঘাটের যমুনাবালা দেবী। স্বামীর পেনশনে সংসার চলে তাঁদের দুজনের। ঘরে কয়েকটি ৫০০ টাকার নোট রয়েছে। এত রাতে কোথায় যাবেন, কীভাবে নোট বদলাবেন, কাল বাজার করবেন কী ভাবে সেটাই বুঝতে পারছেন না। তাই ফেডারেশন অব চেম্বার কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, নর্থ বেঙ্গলের (ফোসিন) সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ দাস বলেন, ‘‘দেশে ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি করে দেওয়া হল। জাল টাকা, কালো টাকা উদ্ধারের কথা বলে সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ীদের সমস্যায় ফেলে দেওয়া হল। হঠাৎ ব্যাঙ্ক বন্ধ, এটিএম বন্ধ-কীভাবে মানুষ সংসার, ব্যবসা করবেন। পর্যটক-সহ নানা ধরণের মানুষ বাড়ির বাইরে টাকা নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আছেন। তাঁরা কী করবেন। বিশ্বজিৎবাবু জানান, কিছু সময় মানুষকে কেন্দ্রের আরও দেওয়া উচিত ছিল। অনলাইনে তো লেনদেন দেশে ক’জন করেন। তাঁদের কী হবে।’’ মালদহ মার্চেন্ট চেম্বার অফ কর্মাসের সম্পাদক উজ্জ্বল সাহা বলেন, জেলা জুড়ে বিশাল আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট ব্র্যান্ড করা হলেও নোটিশ করে জানানো উচিত ছিল। আচমকা নোট বদলের ক্ষেত্রে চরম ক্ষতি হল ব্যবসায়ীদের।
রাজ্যের পর্যটনমন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, ‘‘বিজেপি নেতারা আগেভাগে নিজেদের কালো টাকা সাদা করে, সাধারণ মানুষদের দুর্ভোগে ফেলছে। এই সিদ্ধান্ত বড় ব্যবসায়ীদের প্রভূত সুবিধে হবে। মোদী সরকার বরাবরই সাধারণ বাসিন্দাদের পরিবর্তে ব্যবসায়ীদের কথাই ভেবে আসছে এটাই তার প্রমাণ।’’ পর্যটকদের ভোগান্তি নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন গৌতমবাবু। তিনি বলেন, ‘‘নোট বাতিল করার সিদ্ধান্ত জানানোর পরেই, ব্যাঙ্ক বন্ধ করে দেওয়া হল। বাড়ি ছেড়ে যাঁরা ঘুরতে গিয়েছেন,তাঁরা কী করবেন? তাদের অনেকে তো আটকা পড়ে যেতে পারেন। কী করা যায় দেখা হচ্ছে।’’
জলপাইগুড়ি পুরসভার চেয়ারম্যান মোহন বসু মনে করেন, আইনশৃঙ্খলা অবনতির পরিস্থিতি তৈরি হবে। তিনি বলেন, ‘‘মঙ্গলবার রাত থেকেই অনেকে ৫০০ এবং হাজার টাকার নোট নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে অনেকেই প্রতারণার শিকার হতে পারেন। কোথাও যাতে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে তার জন্য পুলিশকে নজরদারি বাড়াতে বলেছি।’’ জলপাইগুড়ি জেলা ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক সাধন বসুর কথায়, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। সরকার কত ভালভাবে এই পরিস্থিতি সামলাতে পারে সেটাই এখন দেখার।’’
মালদহ মার্চেন্ট চেম্বার অফ কর্মাসের সম্পাদক উজ্জ্বল সাহাও জানিয়েছেন, নানা এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, ‘‘জেলা জুড়ে বিশাল আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। আচমকা নোট বদলের ক্ষেত্রে চরম ক্ষতি হল ব্যবসায়ীদের। ভুগতে হচ্ছে বাসিন্দাদেরও।’’ কোচবিহারের ব্যবসায়ী সংগঠন ফোসিন ও দিনহাটা মহকুমা ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক রানা গোস্বামীও ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘যে ব্যবসায়ীদের প্যান কার্ড নেই, তাঁরা কী করবেন? এই ব্যবসায়ীরা কোথায় যাবে? এটা তুঘলকি সিদ্ধান্ত। এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামা হবে।’’
কোচবিহার ডিস্ট্রিক্ট চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি রাজেন বৈদ ও কোচবিহার জেলা ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক সুব্রত সাহার মতে, নূন্যতম সময়সীমা দিয়ে এমন সিদ্ধান্ত কার্য়কর করা উচিত ছিল। ইংরেজবাজার পুরসভার চেয়ারম্যান কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী বলেন, ‘‘হঠকারী সিদ্ধান্ত. আগাম কিছু না জানিয়ে এটা করায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে শাধারণ মানুষ বিপাকে পড়ে যাবেন। কাল থেকে ওই টাকা লেনদেন বন্ধ করায় ব্যাপক সমস্যা হবে।’’