Advertisement
E-Paper

সংসার ছেড়ে ব্যাঙ্কের সামনে

বাড়ির কর্তা চাকরি করতে ছুটেছেন। কারও স্বামী চা বাগানে কাজে গিয়েছেন। কারও স্বামী শারীরিক ভাবে এতটাই অসুস্থ যে লাইনে দাঁড়াতে পারবেন না। তাই মাস পয়লা পড়তেই কোনও বধূর রান্নার সময় পাল্টে গিয়েছে। কেউ আবার চা বাগানের কাজে যেতে পারছেন না। মাসের প্রথম সপ্তাহে টাকার জন্য হাপিত্যেশ করে লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে তাঁদের। তারই কয়েকটি ছবি তুলে ধরল আনন্দবাজার।মাসের দ্বিতীয় দিনেও টাকা তুলতে গিয়েই খালি হাতে ফিরতে হল পেনশনারদের। কোথাও ব্যাঙ্কের বাইরে বড় বড় করে পোস্টার লাগানো রয়েছে টাকা নেই। কোথাও দুপুরের মধ্যেই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ০২:২৩
সকাল থেকে টাকা তুলতে এসে অপেক্ষায় বধূরা। বালুরঘাটে তোলা অমিত মোহান্তের ছবি।

সকাল থেকে টাকা তুলতে এসে অপেক্ষায় বধূরা। বালুরঘাটে তোলা অমিত মোহান্তের ছবি।

মাসের দ্বিতীয় দিনেও টাকা তুলতে গিয়েই খালি হাতে ফিরতে হল পেনশনারদের। কোথাও ব্যাঙ্কের বাইরে বড় বড় করে পোস্টার লাগানো রয়েছে টাকা নেই। কোথাও দুপুরের মধ্যেই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। মাসের প্রথম দিনই কাজের জন্য টাকা তুলতে আসতে পারিনি। আজ এসে দেখেছি ব্যাঙ্কে টাকা নেই। ভেবেছিলাম পেনশন প্রাপকদের কমপক্ষে হলেও চার হাজার টাকা দেবে। কিন্তু এক টাকাও দিল না। সংসারের তো খরচ রয়েছে। বয়স হয়েছে, বারবার কী আসতে পারি। কিন্তু আসতেই হবে, বারবার।

রথীন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়

(অবসর প্রাপ্তস্কুল শিক্ষক)

বয়স প্রায় আশি পেরিয়েছে. ছেলে মেয়ে কেউ নেই. স্বামী মারা যাওয়ায় পেনশন পাচ্ছি। কিন্তু প্রথম দিন এসেই নানা কাগজ লাগবে বলে পেনশনের টাকা তুলতে পারিনি। আজ সকাল থেকে ব্যাঙ্কে লাইন দিয়েছি। কিন্তু দুপুরে হঠাৎ করেই ব্যাঙ্কের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক চেষ্টা করে বন্ধ দরজা পর্যন্ত এগিয়েছিলাম। কিন্তু লোকেরা চারিদিক থেকে ঠেলাঠেলি করায় সেখানে দাড়িয়ে থাকতে পারিনি। মাথা ঘুরছিল। চোখে অন্ধকার দেখছিলাম। মনে হচ্ছিল জীবন প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছে। পেনশনের টাকা না তুলতে পারলে সংসার আমি চালাব কী করে? ওষুধ বাকিতে খাচ্ছি। দুধের টাকা, বাজার খরচ কোথায় পাব খুব অসহায় মনে হচ্ছে নিজেকে।

বকুলরানি দে

(পেনশন প্রাপক)

গ্রাহকদের বিক্ষোভ

ব্যাঙ্কে টাকা না পেয়ে বিক্ষোভ দেখালেন গ্রাহকেরা। ডুয়ার্সের নাগরাকাটার বাজারের এক মাত্র রাষ্টায়ত্ত ব্যাঙ্কে শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত এক ঘণ্টা বিক্ষোভ দেখান গ্রাহকেরা। গত কিছু দিন ধরেই ব্যাঙ্কে টাকা না থাকার ফলে গ্রাহকরা বিপাকে পড়েছেন। তবে বিক্ষোভ দেখিয়েও এ দিন টাকা মেলেনি। তবে আজ শনিবার টাকা আসার কথা রয়েছে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তৃণমূলের তরফে ডুয়ার্সের ক্রান্তির উত্তরবঙ্গ ক্ষেত্রীয় গ্রামীণ ব্যাঙ্কে অবস্থান বিক্ষোভ দেখিয়ে দ্রুত গ্রাহকদের টাকা দেবার আর্জি জানিয়ে স্মারকপত্র দেওয়া হয়। ক্রান্তি ব্লক তৃণমূল কমিটির পক্ষে প্রায় দু’ঘন্টা ব্যাঙ্কের সামনে বিক্ষোভ দেখানো হয়।

পরীক্ষা সত্ত্বেও লাইনে

সামনেই অনেক জায়গায় পরীক্ষা। তবু ব্যাঙ্কের লাইন থেকে নিষ্কৃতি মিলছে না। অভিভাবকেরা চতাই চিন্তিত। সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী বেতন ১০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা, অথচ তুফানগঞ্জের বেশিরভাগ ২ হাজার টাকার বেশি মিলছে না। ওই অভিযোগ তুলে তুফানগঞ্জে আন্দোলনে নামল তৃণমূল মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি। শুক্রবার তুফানগঞ্জ শহরের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কেও স্মারকলিপি দেওয়া হয়।

জাতীয় সড়ক অবরোধ

উত্তরবঙ্গ ক্ষেত্রীয় গ্রাম ব্যাঙ্কে টাকা না পেয়ে জলপাইগুড়ির তালমাহাট এলাকায় ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করলেন গ্রাহকরা৷ আসপাশে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত আর কোনও ব্যাঙ্ক না থাকায় ওই ব্যাঙ্কের উপর এলাকার প্রচুর মানুষ নির্ভরশীল৷ নোট সমস্যার পর থেকেই প্রতিদিন প্রচুর মানুষ ব্যাঙ্কে ভিড় জমাচ্ছেন৷ এ দিন সকাল থেকে লাইনে দাঁড়ানোর পর বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ ব্যাঙ্ক থেকে জানানো হয় টাকা দেওয়া হবে না৷ এরপরই ক্ষোভে ফেটে পড়েন গ্রাহকরা৷

কী বলছেন ম্যানেজার

১২ নভেম্বর থেকে কার্যত কাজের চাপ দ্বিগুণ হয়েছে। কর্মীরা সকাল ন’টার মধ্যে ব্যাঙ্কে ঢুকছে। রাতে ব্যাঙ্কের হিসেব মিলিয়ে যেতে প্রায় সাড়ে ন’টা থেকে দশটা বেজে যাচ্ছে। কার্যত না খাওয়া ভুলে কাজ করতে হচ্ছে। আমাদের আলিপুরদুয়ার চৌপথী শাখায় ভোর ছ’টা থেকে গ্রাহকরা লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। অনেক সময় খাওয়া আনতে না পেরে সকল কর্মী মিলে মুড়ি চানাচুর খেয়ে কাজ করছি। এখন বিয়ের মরসুম। যে সমস্ত গ্রাহকদের বাড়িতে বিয়ে রয়েছে তাদের যতটা বেশি পারছি টাকা দেওয়ার চেষ্টা করছি। চিকিৎসার জন্য যাঁরা টাকা তুলছেন, তাঁদের বিশেষ ভাবে দেখা হচ্ছে। লম্বা লাইনে রোজ রোজ গ্রাহকরা দাঁড়িয়ে থাকছেন। আমরা হাসি মুখে পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।

প্রেমাংশু গুহ

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজার

ভোর ৫টায় উঠেছি। ছেলেকে খাইয়ে তৈরি করে স্কুলে পাঠিয়েছি। ভাইও কাজে গিয়েছে। কোনমতে ১১টার সময়ে ছুটতে ছুটতে ব্যাঙ্কে লাইনে দাঁড়িয়েছি। টাকা পাব কি না, জানি না। না হলে আবার শনিবার দাঁড়াতে হবে। এভাবে ছোটাছুটি করতে গিয়ে নিজে কাজে যেতে পারছি না। কিন্তু উপায় নেই। সংসার চালাতে হবে।

নির্মলা দর্জি

মূর্তি চা বাগান (মালবাজার)

স্বামী গাড়ি চালান। সেই সকালে বেরিয়ে গিয়েছেন। তিনি লাইনে দাঁড়ালে সংসার চলবে কী করে? তাই ভোরে উঠে ডিমের ঝোল-ভাত রান্না করে বাচ্চা কোলে লাইনে দাঁড়িয়েছি। বৃহস্পতিবার দাঁড়িয়ে টাকা পাইনি। শেষ হয়ে গিয়েছিল। আজ ফের দাঁড়িয়েছি। না পেলে আবার কাল। এ ভাবে পারছি না। আমি একা নই। আরও অনেকে আছেন।

কল্পনা ছেত্রী

জলপাইগুড়ি

স্বামী অসুস্থ। সকালে ৯টায় এসেও ডাকঘরের লাইনে ১১০ জনের পরে দাঁড়িয়েছি। ৯৮ জন টাকা পেয়েছে। তার পরে টাকা নেই। তাড়াহুড়ো করে ফের এসবিআইয়ের লাইনে গিয়ে দাঁড়াই। সেখানে ২০০০ টাকা পেয়েছি। তাতে কিছু দোকানের ধার শোধ দেব। কাল আবার রান্না সেরে লাইনে দাঁড়াব। খবর রাখছি, কোথায় টাকা আছে।

স্বপ্না রাহা

ফাটাপুকুর (জলপাইগুড়ি)

স্বামী অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। তাঁর পক্ষে লাইনে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। আমাকেই রোজ লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে। একটু কষ্ট তো হচ্ছেই। এমন তো অভ্যাস নেই। কিন্তু, তা মুখ বুজে সহ্য করতে রাজি আছি। তবু কালো টাকা উদ্ধার হোক।

পুতুল সোম

জলপাইগুড়ি

অফিস থেকে তো রোজ রোজ টাকা তোলার জন্য ছুটি নেওয়া যায় না, তাই আজকে স্বামীর পরিবর্তে আমিই কার্ড হাতে টাকা তোলার যুদ্ধে নেমেছিলাম। ছেলে-মেয়ের টিউশন ফি-ও দিতে হবে। দুপুর বেলায় রান্না সেরেই তাই এটিএমের লাইনে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। পৌনে তিনটের সময় যখন লাইনে দাঁড়িয়েছি, তখন এটিএমে টাকাই ভরা হয়নি। শুধু শোনা গিয়েছিল, টাকা ভরা হবে। তাতেই সকলে লাইনে দাঁড়িয়েছিল। তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা পেয়েছি। আজ তো দু’হাজারে হয়ে গেল, কাল কী হবে জানি না।

দীপিকা বসাক

শিলিগুড়ি

গতকাল এটিএমে লাইন দিয়েছিলাম। আজ ব্যাঙ্কে। টাকা জোগাড় করতে দু’দিনে প্রায় ৮ ঘণ্টা তো লাইনেই চলে গেল। সকালে মেয়েদের স্কুলে পাঠিয়ে ব্যাঙ্কে দৌড়তে হয়েছে দু’দিন। বাড়ির সব কাজ আপাতত মুলতুবি রাখতে হয়েছে। দুপুর-রাতের খাওয়ার মেনুতেও ছেদ পড়েছে। তার থেকেও বড় সমস্যা হল কোন এটিএমে টাকা পাওয়া যাচ্ছে শুনে ছুটোছুটি এবং চড়া রোদে লাইন দিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছি। কিন্তু আবার লাইনে এসে দাঁড়াতে হবে।

সোমা চক্রবর্তী

শিলিগুড়ি

Bank Distress
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy