যাঁর অধীনে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় পিএইচডি করেছেন, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সেই অনিল ভুঁইমালিকে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে বসাল রাজ্য সরকার। বিরোধী শিবিরের অনেকেই একে পার্থবাবুর ‘গুরুদক্ষিণা’ বলে মনে করছেন। প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য তো স্পষ্টই বলছেন, ‘‘এ হল শিক্ষামন্ত্রীর গাইড হওয়ার পুরস্কার।’’
কী বলছেন শিক্ষামন্ত্রী? পার্থবাবুর দাবি, ‘‘সার্চ কমিটির সুপারিশ খতিয়ে দেখে রাজ্যপাল ওই নিয়োগপত্র দিয়েছেন। এতে সরকারের ভূমিকা নেই।’’ তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, তাঁর শিক্ষকরা যোগ্যতা থাকলেও সরকারি পদে থাকতে পারবেন না, এমন দাবি করলে তাঁদের অমর্যাদা হয়। শিক্ষামন্ত্রীর দাবি, ‘‘অনিলবাবু উত্তরবঙ্গের তফশিলি সম্প্রদায়ের মানুষ। তিনি উপাচার্য হলে তা সকলেরই গর্বের বিষয়।’’
তৃণমূল সূত্রের খবর, পার্থবাবু বিধানসভার বিরোধী দলনেতা থাকাকালীন গোড়ায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার জন্য যোগাযোগ করেন। ইতিমধ্যে তাঁকে উত্তরবঙ্গের দলের দায়িত্ব দেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঘনঘন উত্তরবঙ্গে যাতায়ত করতে হতো তাঁকে। সেই সময়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিপুল মালাকারের পরামর্শে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান অনিলবাবুর অধীনে গবেষণা শুরু করেন পার্থবাবু। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধির জটিলতা কাটিয়ে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পার্থবাবু গবেষণার ছাড়পত্র পান। তবে নানা মহল থেকে অভিযোগ ওঠে, পার্থবাবুর জন্য বিধিনিষেধের ফাঁস আলগা করেছে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি, ইউজিসি-র বিধি মেনে পার্থবাবু ক্লাস করেছেন। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে পার্থবাবু পিএইচডি পান।
প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য-সহ বাম নেতাদের অনেকেই অনিলবাবুর উপাচার্য হওয়ায় রাজনীতি দেখছেন। বাম আমলে অনিলবাবু বিশ্ববিদ্যালয়ের বামপন্থী সংগঠনের নেতা ছিলেন। প্রাক্তন পুরমন্ত্রী বলেন, ‘‘পার্থবাবু কখনও শিল্পমন্ত্রী, কখনও শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে ব্যস্ত থেকেও এত ক্লাস (ন্যূনতম ১৬টি ক্লাস) করেছেন? আসলে নানা কৌশলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিকে পাশ কাটানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই শিক্ষামন্ত্রীর ‘গাইড’ হিসেবে ‘পুরস্কার’ মিলেছে অনিলবাবুর।’’
উত্তরবঙ্গের শিক্ষক-প্রশাসকদের একাংশের মতে, ডিন, রেজিস্ট্রার, সহ-উপাচার্যের মতো কোনও প্রশাসনিক পদে অনিলবাবু কখনও কাজ করেননি। অথচ সার্চ কমিটি অনিলবাবুর সঙ্গে অন্য যে দুই প্রার্থীর নাম বিবেচনা করেছিল, তার একজন দীর্ঘদিন একটি কলেজের অধ্যক্ষ থাকার পর এখন অস্থায়ী রেজিস্ট্রার। অন্যজন কলকাতার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিন পদে অনেকদিন রয়েছেন। তা সত্ত্বেও অনিলবাবুকেই বাছা হয়েছে।
তবে এর মধ্যে পক্ষপাতিত্ব দেখতে নারাজ শিক্ষা দফতর। দফতরের এক কর্তা জানান, প্রেসিডেন্সির উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়া, বর্ধমানের উপাচার্য স্মৃতিকুমার সরকার, রবীন্দ্রভারতীর উপাচার্য সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী প্রমুখদের নিয়োগের আগে তেমন প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই তা নির্ণায়ক শর্ত বলে ধরা চলে না।
উত্তরবঙ্গের শিক্ষা জগতের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই তফসিলি সম্প্রদায়ের ভূমিহীন খেতমজুরের ছেলে অনিলবাবুকে উপাচার্য করায় উচ্ছ্বসিত। দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুর ব্লকের ফুলবাড়ির পঞ্চাগ্রামে আদি বাড়ি তাঁর। অভাবের জন্য অনিলবাবু লেখাপড়া ছেড়ে দিনমজুরি করতেও বাধ্য হয়েছিলেন। প্রাইভেটে মাধ্যমিক পাস করেন। বালুরঘাট কলেজ থেকে অর্থনীতি নিয়ে স্নাতক হন। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার পরে দিল্লিতে একটি জাতীয় সংস্থায় গবেষক হিসেবে যোগ দেন। পরে দিনহাটা কলেজে কিছুদিন কাজ করে, যোগ দেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
শুক্রবার উপাচার্যের নিয়োগপত্র হাতে পাওয়ার পরে অনিলবাবু প্রতিক্রিয়া, ‘‘কে, কী বলছেন জানি না। এটুকু বলতে পারি, ভূমিহীন খেতমজুর পরিবারের ছেলে হিসেবে অভাব থাকলে লেখাপড়া করতে কী লড়াই করতে হয় সেটা বুঝি। আশা করি, জেলার অভাবী পরিবারের পড়ুয়াদের পাশে দাড়াতে পারব।’’
৩ জানুয়ারি রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। যে রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজে নিত্য গোলমালের জন্য কেউ স্থায়ী অধ্যক্ষ হতে চান না, সেখানে একজন ‘লড়াকু’ মানুষকে উপাচার্য হিসেবে পেয়ে খুশি শিক্ষক-কর্মীরাও। ওই কলেজের শিক্ষক তথা প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দেবাশিস বিশ্বাস বলেন, ‘‘পুরস্কার, গুরুদক্ষিণা এসব মন্তব্য করলে অনিলবাবুর অমযার্দা করা হয়। ওঁর এই জায়গায় পৌঁছনটাই তো সকলের কাছে একটা দৃষ্টান্ত।’’