নিভু নিভু দিনের আলো। এ-দিক ও-দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পেশীবহুল চেহারার কয়েক জন মানুষ। উপরে নজর রাখছে সিসিটিভি ক্যামেরা। ভিতরে খবর গিয়েছে, আমরা অপেক্ষায়। তার পরেও কিছুক্ষণ দাঁড়াতে হল।
এই সময়ে মনে হচ্ছিল, এ বারেও কি তবে শেষ মুহূর্তে তিনি বাতিল করে দেবেন সাক্ষাৎকার? যেমন আগের বারে করেছিলেন? ইতিমধ্যেই তাঁর তরফে জানানো হয়েছে, দশ মিনিটের বেশি সময় মিলবে না। তা-ও আমরা অপেক্ষায় আছি।
ভিতর থেকে একটি কিশোর এসে ডেকে নিয়ে গেল আমাদের। সিংহদুয়ার খুলে গেল। আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকা রক্ষীটি একটি খাতা এগিয়ে দিলেন। সেখানে নাম-ধাম এবং সময় লিখে এগোলাম তাঁর দরবারে। ঘড়ি দেখলাম আড় চোখে, ছ’টা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি।
এর পরে যে পৌনে দু’ঘণ্টা সেখানে ছিলাম, পুরো সময়টায় বারবার মনে হয়েছে, যিনি নিজের সম্পর্কে বলেন, মানুষের জন্য কাজই তাঁর লক্ষ্য, তিনি এত ঘেরাটোপে আর রহস্যের মধ্যে আটকে রাখেন কেন নিজেকে? এই রহস্যের মোড়কই কি অনন্ত মহারাজের জনপ্রিয়তার চাবিকাঠি?
এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মহারাজ নিজে বলেন, ‘‘আমি সাধারণ মানুষের কাছের লোক। আমার কাছে আসতে তাদের কোনও সমস্যা হয় না।’’ যেখানে বসে আমাদের কথা হচ্ছিল, সেখানেই বসে তাঁর আম-দরবার। জানালেন সে কথাও।
অথচ এখানে আসার আগে আমাদের বিশেষ করে কিছু বিষয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল। জানানো হয়েছিল, দশ মিনিটের বেশি সময় মিলবে না। যদিও কথা শুরু হওয়ার পরে সময় আর বাঁধা থাকেনি। আতিথেয়তাতেও কমতি হয়নি। তবু একটা বিষয় বিলক্ষণ বোঝা যাচ্ছিল। সাংবাদিকদের জন্য যতই কড়াকড়ি থাকুক, স্থানীয় মানুষজনের ক্ষেত্রে সিংদরজার আগল বিশেষ শক্ত নয়। যে কিশোর আমাদের দরবার পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেল, সে তার পরে বেরিয়ে গেল অক্লেশে। দু’চার জনের আনাগোনা লেগেই ছিল পুরো সময়টায়। বাড়িতে ঢুকতে-বার হতে তাদের পরীক্ষায় পড়তে হয়নি আমাদের মতো।
‘‘আমাকে এখানকার মানুষ ভালবাসে। তাদের বিপদে আপদে আমি রয়েছে,’’ বলছিলেন তিনি। তাই যখন পুলিশের চাপে তাঁকে কোচবিহার ছেড়ে অসমে চলে যেতে হয়েছিল, তখন এই অঞ্চলের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, দাবি করলেন অনন্ত। সেই ক্ষোভ এখনও পুরোপুরি যায়নি, জানিয়ে দেন তিনি। আরও জানিয়ে দেন, এই যে নারায়ণী সেনার লোকজনকে নারায়ণী ব্যাটালিয়নে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী, তাতেও পুরোপুরি সেই ক্ষোভ প্রশমিত হবে কি না সন্দেহ। কেন? তিনি বলেন, ‘‘আমার হেনস্থার কথা মনে করে অনেকেই এখনও ক্ষুব্ধ। তাঁরা তো আমাকে ভালবাসেন। জানেন, আমার উপরে কী অত্যাচার হয়েছিল।’’
তা হলে কি সত্যিই তিনি মাটির কাছের মানুষ, ধরাছোঁয়ার মধ্যে? তা যে নয়, সেটা ভাল ভাবেই জানেন রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। এই বর্ষীয়ান তৃণমূল নেতা মাঝেমধ্যেই আসেন মহারাজের বাড়িতে। কিন্তু প্রথম থেকেই সাক্ষাতে কিছু বাধা তাঁকেও টপকাতে হয়েছে। নিজেও যেন রহস্যময় ভাবমূর্তিটা ধরে রাখতে চান মহারাজ। তাঁর রহস্যময় হাসি, বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ধরন, বাক্য অসমাপ্ত রেখে ইঙ্গিতে কথা বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা— এ সবই যেন তাঁর ভাবমূর্তি গঠন করার প্রক্রিয়া।
তাই অনন্তকে ঘিরে রহস্য ফুরোয় না। সেটাই তাঁর ‘ইউএসপি’। তিনি জানেন, রহস্য যত দিন, কিং-মেকার হিসেবে তাঁর গুরুত্বও তত দিন। রহস্য ফুরোলে তিনিও হয়ে যাবেন আর পাঁচ জন রাজনীতিকের মতো সাধারণ।
এখানেই ঘোরতর আপত্তি অনন্তের। তাই এখনও তিনি ওই অঞ্চলের ‘মহারাজ’। (শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy