মায়ের সঙ্গে নেতাজি পার্কের বাড়িতে তথাগত। ছবি: মনোজ মুখোপাধ্যায়।
দু’বছর আগে টেস্ট পরীক্ষার পর পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় বাবার। সে বার আর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। বাবার মৃত্যুর পরেই বদলে যায় সংসারের চিত্রটাও। অভাব হয়ে ওঠে নিত্য দিনের সঙ্গী। এমন প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে ৪১১ নম্বর পেয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে তথাগত সরকার। সে অক্রুরমণি করোনেশন ইনিস্টিটিউশনের ছাত্র। তথাগতের এমন সাফল্যে খুশি পরিবার থেকে এলাকার লোকেরাও। সে বাংলায় ৭১, ইংরেজিতে ৮৫, ভৌত বিঞ্জানে ৮৫, রসায়নে ৮৮, জীব বিদ্যায় ৭৬ নম্বর পেয়েছে।
ইংরেজবাজার শহরের ২৫ নম্বর ওর্য়াডে নেতাজি পার্ক এলাকার বাসিন্দা তথাগত। পরিবারে এক মাত্র সঙ্গী মা মমতাদেবী। বাবা মৃত্যুঞ্জয় সরকার ২০১৩ সালের ২ জুন পথ দুর্ঘটনায় মারা যান। তিনি হবিবপুরের শ্রীরামপুর হাই স্কুলে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী ছিলেন। পরিবার সূত্রে জানা যায়, তাঁদের বাড়ি ছিল শ্রীরাম পুরের সিঙ্গাবাদে। এক মাত্র ছেলেকে ভাল স্কুলে পড়াবেন বলে ২০০৯ সালে গ্রামের ভিটে মাটি বিক্রি করে শহরের এই ওর্য়াডে বসবাস শুরু করেন। মৃত্যুঞ্জয়বাবু বেঁচে থাকাকালীন অভাব কী তা কখনও বুঝতে পারেনি তথাগত।
তবে একটা পথ দুর্ঘটনা বদলে দিল পরিবারের চিত্রটা। ২০১৩ সালের ওই দিন ফরাক্কা থেকে আত্মীয়ের বিয়ের নেমতন্ন খেয়ে ফেরার পথে কালিয়াচক থানার ১৬ মাইলে দু’টি গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। মৃত্যু হয় মৃত্যুঞ্জয়বাবুর। সেই সময় তথাগত উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। টেস্ট পরীক্ষাও হয়ে গিয়েছিল। বাবার মৃত্যুর পর মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে সে। মায়ের পেনশনরে জন্য শুরু হয় ছোটাছুটি। এমন অবস্থায় আর পরীক্ষায় বসা হয়নি। যার জন্য এক বছর পর ফের পরীক্ষায় বসার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে তথাগত।
পরিবারের যা অবস্থা, তাতে গৃহ শিক্ষক নেওয়ার কথা ভাবতে পারেনি সে। বাড়িতে নিজেই পড়াশোনা করত। গৃহশিক্ষক বন্ধু সৌমদীপ সরকার। সে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথন বর্ষের ছাত্র। তাঁর কাছ থেকেই ভৌত বিজ্ঞান পড়েছে। তবে সব সময়ের জন্য নয়। যখন সে ছুটিতে আসত, তখন তাঁর কাছ থেকে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করত।
তথাগতর কাছ থেকেই জানা গেল, বাবার মৃত্যুর পর ১৯ মাস কোনও আয় ছিল না তাদের। ১৯ মাস পর মা মমতাদেবী পেনশন পেতে শুরু করেন। তবে পেনশনের টাকায় বিভিন্ন বিষয়ে গৃহশিক্ষক নিয়োগ সম্ভব ছিল না। তাই কষ্ট করেই পড়াশোনা চালিয়ে যায় সে। দিনে সাত থেকে আট ঘণ্টা পড়াশোনা করত আর স্কুলের ক্লাসগুলি নিয়মিত করত। এ ভাবেই পড়াশোনা করে উচ্চ মাধ্যমিকে সফল হয়েছে সে।
তথাগত বলে, ‘‘ভৌত বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে গবেষণা করার ইচ্ছে রয়েছে। তবে কতটা হবে আমি জানি না। কারন পেনশনের ক’টা টাকাতেই আমাদের সংসার চলে। বাইরে পড়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় বলে এখানে কলেজে ভর্তি হব। তবে আমাকে স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে বন্ধুরা সবাই খুব সাহায্য করেছে।
ছেলের ফলাফলে খুশি মমতাদেবী। তিনি বলেন, ‘‘ওর বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের দু’বেলা খাবার জোগাড় করতেই সমস্যায় পড়তে হতো। ও রাত জেগে পড়াশোনা করত। একটু যে ভালমন্দ খাওয়াব তার উপায় ছিল না। পাড়া পড়শিরা আমাদের অনেক সাহায্য করেছে। তাঁরা প্রায়ই ওর জন্য খাবার দিয়ে যেত। ওর স্বপ্ন সার্থক করতে পারব কি না, বুঝতে পারছি না।’’ অক্রুরমণি স্কুলের প্রধান শিক্ষক চঞ্চল ঝা বলেন, ‘‘তথাগত খুব ভাল ছেলে। সে নিজে নিজে পড়াশুনা করে এমন ফল করেছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy