E-Paper

স্বাধীনতার অর্থ আজও অধরাই

স্বাধীনতা কি চলা, বলা বা কাজে যথেচ্ছ ইচ্ছানুসারী? নাকি অন্যের অধিকার আর ইচ্ছাকে দাবিয়ে রাখাও আমাদের স্বাধীনতার এক্তিয়ারভুক্ত?

সুমনা ঘোষদস্তিদার

শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০২৫ ০৭:৫৬
—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

দিনক্ষণ, বছরের নিরিখে প্রতিটি জন্মদিনে কেক ঘিরে সারি সারি মোমের আলো এক বুক শ্বাসবায়ু ভরে নিভিয়ে দেওয়াই দস্তুর। এই সংস্কৃতি অন্য দেশ থেকে ধার করা হলেও কী এসে যায়!

ভারতের ৭৯-তম স্বাধীনতার জন্মদিনে শুধু লালকেল্লা বা রেড রোড নয়, দেশের সর্বত্র যখন মাথা উঁচু করে তেরঙা পতাকা উড়েছে, দেশ ও দেশের নাগরিকের প্রতি আশ্বাস ও অঙ্গীকার ঘোষিত হয়েছে দিকে দিকে, তখনও কি আমরা বুকে হাত রেখে বিগত বছরের সব স্মৃতি এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে সত্যিই সগৌরবে বলতে পারছি, আমরা স্বাধীন দেশের সভ্য নাগরিক? বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম (১০৬ বার সংশোধিত) সংবিধানকে আমরা মেনে চলি?বিচার-শাসনব্যবস্থায় সম্পূর্ণ আস্থা রয়েছে?

হয়তো তা বলতে পারি না।

যেমন মানতে পারি না, আর জি করের সেই কর্তব্যরত অবস্থায় ডাক্তার মেয়েটির ধর্ষণ, পহেলগামের সন্ত্রাসবাদীদের ধর্মের বিচারে নির্দোষ মানুষের হত্যা, প্রয়াগের মহাকুম্ভে মর্মান্তিক পদপিষ্টের ঘটনা বা ২৬ হাজার কর্মরত শিক্ষকের চাকরি হারানোকে।

আবার যে সব ঘটনা প্রচারের আলো পেয়েছে, মনে রেখেছি বহু দিন, কিন্তু যে মেয়েটি স্বপ্ন গেঁথে গেঁথে ছেলেটির হাত ধরে ঘর ছেড়েছিল, সেই মেয়েটিই প্রতি রাতে শরীর জুড়ে অত্যাচারের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে। ঘরে ঠাঁই না পেয়ে যে সদ্যোজাতকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে আস্তাকুঁড়ে, যারা আজও কাজের প্রলোভনে পা দিয়ে ভিন্‌ দেশে পাচার হচ্ছে, পণের টাকা কম পড়ে গেলে আগুনে জ্বলছে বধূর শরীর, অশীতিপর মা-বাবার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে তাঁদের আদরের সন্তান?

নিরন্তর এমন কত শত অন্যায় হয়ে চলেছে আমাদের জন্মভূমিতে। স্বাধীনতা কি চলা, বলা বা কাজে যথেচ্ছ ইচ্ছানুসারী? নাকি অন্যের অধিকার আর ইচ্ছাকে দাবিয়ে রাখাও আমাদের স্বাধীনতার এক্তিয়ারভুক্ত? স্বাধীনতা তো এ কথাই বলে— ‘নারীটি নিশ্চিন্তে তার চোখে চোখ রাখুক যে তাকে দু’দণ্ড শান্তি দেয়, নিজেকে সাজাক মানুষ, যেমনটি তার মন চায়, মানুষ সেই কর্মক্ষেত্র খুঁজে নিক, যে কাজে সে স্বচ্ছন্দ, সমকামী মানুষটি সঙ্গীর হাতে রাখুক হাত, পতিতাবৃত্তিকে আর পাঁচটি কাজের মতোই শ্রদ্ধায় দেখা হোক, শ্রদ্ধার আসন পাক বৃহন্নলা সমাজ।

কিন্তু আমরা আর কত যুদ্ধ করব রূঢ় মানব-প্রকৃতির চিরন্তন নিষ্ঠুরতার সঙ্গে?

যে স্বাধীনতার অর্থ আজও অধরাই রয়ে গিয়েছে, প্রকৃত স্বাধীনতার অস্তিত্বহীনতার জন্যই কি এত আঁধার? সম্ভবত এর মূলে রয়েছে উপযুক্ত শিক্ষার অভাব। তাই কখনও কখনও স্বাধীনতার সঙ্গে দায়হীনতাকে হয়তো আমরা গুলিয়ে ফেলছি অধিকারের দোহাই দিয়ে।

খুব মনে পড়ছে ২২৫ বছর আগে তিনি যা বুঝেছেন, আজও কেমন তা সমান প্রাসঙ্গিক। তিনি লিখেছেন, ‘‘আমি যাহা বলিব, সকলকেই তাহা বলিতেই হইবে, আমি যাহা করিব, সকলকেই তাহা করিতেই হইবে, এই রূপ বলপ্রয়োগে দেশের সমস্ত মত ও আচরণ বৈচিত্রের অপঘাত মৃত্যুর দ্বারা পঞ্চত্বলাভকেই আমরা জাতীয় ঐক্য বলিয়া স্থির করিয়া বসিয়াছি। মতান্তরকে আমরা সমাজে পীড়ন করিতেছি কাগজে অতি কুৎসিতভাবে গালি দিতেছি, এমনকি, শারীরিক আঘাতের দ্বারাও বিরুদ্ধ মতকে শাসন করিব বলিয়া ভয় দেখাইতেছি।’’

নিশিদিন ভরসা রাখি, সবটুকুই তো আঁধার নয়, এর মাঝেও আলো আছে, আলো আছে এর পরেও, সন্তানের মুখ চুম্বন আছে, তার চোখে গভীর ভাবে তাকানো আছে, ভালবেসে পথ চলা আছে, পারস্পরিক শ্রদ্ধায় যৌথ যাপন আছে। তাই আজও মনে প্রাণে এই ইচ্ছেই লালন করি, ‘ভারতের সেই স্বর্গে করো জাগরিত।’

শিক্ষিকা, জলপাইগুড়ি

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Independence Day 2025

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy