Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪
বালুরঘাট বৃত্তান্ত

আটকে রয়েছে জলের প্রকল্প, গা নেই কারও

কোথাও জল মেলে ঠিকঠাক। কোথাও সরু ধারায় পড়ে পানীয় জল। কোথাও জল মেলাই ভার। অথচ বালুরগাটের জলছবিটা অনায়াসে বদলে যেতে পারে। কিন্তু, গয়ংগচ্ছ মনোভাবের জেরে কাজ হোঁচট খায় বারেবারেই। বালুরঘাটের জল-ছবি নিয়ে লিখছেন অনুপরতন মোহান্ত। শহরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের বেলতলাপার্ক এলাকার বাসিন্দা সুজিত দত্ত সকাল থেকে পাড়ার ট্যাপ কলের দিকে চেয়ে থাকেন। আর ঘড়ি দেখেন। কখন জল পড়বে সময়ের ঠিক নেই। এলাকার অধিকাংশ হস্তচালিত নলকূপ থেকে জল ওঠে না।

একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন! এমনই অবস্থা রাস্তার ধারের কলে। বালুরঘাটে তোলা অমিত মোহান্তর ছবি।

একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন! এমনই অবস্থা রাস্তার ধারের কলে। বালুরঘাটে তোলা অমিত মোহান্তর ছবি।

শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৬ ০১:৫২
Share: Save:

শহরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের বেলতলাপার্ক এলাকার বাসিন্দা সুজিত দত্ত সকাল থেকে পাড়ার ট্যাপ কলের দিকে চেয়ে থাকেন। আর ঘড়ি দেখেন। কখন জল পড়বে সময়ের ঠিক নেই। এলাকার অধিকাংশ হস্তচালিত নলকূপ থেকে জল ওঠে না। সুজিতবাবুর অভিযোগ, কোনও দিন সকাল ৭টায় জল এসে সাড়ে ৮টায় চলে যায়। আবার কোনও দিন সকাল ৮টায় জল এসে আধঘন্টার বেশি থাকে না। ট্যাপে লাইন পড়ে যায়। গরমের সময় খাবার জল জোগাড় করতে বাড়তি ঘাম ছুটে যায়। পাশের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের রাহাপাড়া এলাকার বাসিন্দাদের আবার পিএইচইর ট্যাপের জল ধরাছোঁয়ার বাইরে। এলাকার বধূ জয়শ্রী দেব, চন্দনা রাহাদের অভিযোগ, পানীয় জল আনতে গেলে প্রায় ২০০ মিটার দূরে বড় রাস্তা পেরিয়ে কাউন্সিলারের বাড়ির সামনে যেতে হয়। রাস্তায় হাম্প নেই। প্রায়ই বাইকের ধাক্কায় দুর্ঘটনায় আহত হচ্ছেন প্রতিবেশীরা। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বিশুদ্ধ জল খাওয়াটা স্বপ্নই থেকে যায় বলেন, জয়শ্রী, রিয়া রাহারা। বস্তুত ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে অপ্রতুল ট্যাপ কলের কারণে হস্তচালিত নলকূপের জলই ভরসা বাসিন্দাদের। যেমন ৪ নম্বর ওয়ার্ডের গার্লস কলেজ পাড়ার বধূ সারথি পাহান, শম্পা পাহানদের মতো সকলের ভরসা পুরসভার বসানো হস্তচালিত নলকূপের জল। পুরসভার ইঞ্জিনিয়র বিভাগ জানিয়েছে, এই মুহূর্তে শহর জুড়ে প্রায় ৯০০টি হস্তচালিত নলকূপ রয়েছে।

তাই পরিস্রুত পানীয় জলের নাগাল পেতে গেলে রাহাপাড়ার মতো সারথি, শম্পাদেরও অলিগলি পেরিয়ে ছুটতে হয় অনেকটা দূরে। ৪ নম্বর ওয়ার্ডের অধীন উত্তমাশাপল্লি এলাকায় দীর্ঘ গলির রাস্তার দুধারে ঘন জনবসতি। ওই গলির বাসিন্দা ওয়ার্ড কাউন্সিলার আরএসপির কৃষ্ণা সরকার। অথচ এলাকায় সবেধন নীলমণির মতো একটি মাত্র পিএইচইর ট্যাপ। ওই ট্যাপ দিয়ে সরু ধারায় জল পড়ে। এলাকার গৃহবধূ জয়শ্রী ভাদুড়ি বলেন, ‘‘পাড়ায় আর একটি ট্যাপ বসবে জেনে সকলের অনুরোধে ট্যাপের জন্য জায়গা ছেড়ে সীমানা পাঁচিল তৈরি করেছি। কিন্তু আজও ট্যাপ বসল না।’’ আরএসপির কাউন্সিলার কৃষ্ণাদেবীর অভিযোগ, ‘‘আমার ৪ নম্বর ওয়ার্ডে ট্যাপের সংখ্যা অত্যন্ত কম। বহু বার পুরকর্তৃপক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট বিভাগে জানিয়েছি। কাজ হয়নি।’’

আবার ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে প্রাচ্যভারতী পাড়া এলাকায় ৩০ থেকে ৪০ মিটার দূরে দূরে একটি করে জলের ট্যাপ রয়েছে। যেখানে পিএইচইর নিয়ম মেনে দিনে তিন বার জল এলেও সকালের দিকে খুব অল্প সময় জল থাকে বলে বাসিন্দাদের দুর্ভোগে পড়তে হয় বলে অভিযোগ। পিএইচইর নিয়ম মতো দুপুর ১১টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত জল দেওয়ার পর সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মঙ্গলপুরের ভাটাকলোনি এলাকায় পুকুরের ধারে একমাত্র ট্যাপটি থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত জল পান বাসিন্দারা। কেননা অন্য ওয়ার্ড থেকে এলাকাটি অনেকটা নিচু।

তৃণমূল পারিচালিত বালুরঘাট পুরসভার ইঞ্জিনিয়র বিভাগ সূত্রে জানা গিয়েছে, শহরের মোট ২৫টি ওয়ার্ডের কোনও এলাকাতেই সম্পূর্ণ ভাবে পিএইটই পানীয় জল পৌঁছয়নি। আর এখান থেকেই বহু চর্চিত জল-রাজনীতির আবর্তে পাক খেতে হচ্ছে একটি প্রাচীন জনপদ—বালুরঘাটের মানুষকে। কেননা সারা বছর ভুলে থাকলেও পুরভোটের সময় পানীয় জলই শাসক-বিরোধী দলগুলির নেতাদের প্রচারের প্রধান হাতিয়ার হয়ে ওঠে। প্রায় ৬০ বছরের বালুরঘাট পুরসভায় প্রায় ৫০ বছর ধরে একটানা ক্ষমতায় ছিল আরএসপি। অভিযোগ, শহরের বাসিন্দাদের পানীয় জল সরবরাহের দায়িত্ব পিএইচইর উপর, তাই বলেই এতকাল তারা দায় সেরেছে। কারিগরী কর্মীর সহায়তা ও তহবিলের সমস্যা তুলে বিগত বছরগুলিতে আরএসপি পরিচালিত বালুরঘাট পুরসভা দায়িত্ব এড়িয়েছে। ২০১৩ সালে পুরসভার ক্ষমতায় এসে তৃণমূল পুর কর্তৃপক্ষকেও সেই সমস্যার কথাই তুলে ধরতে হচ্ছে। তাই গোটা শহরে ট্যাপ কলের মাধ্যমে যতটুকু পানীয় জলের সরবরাহ বাসিন্দারা পাচ্ছেন, তা পিএইচইর সৌজন্যে। কেননা, এই শহরের জলে মাত্রাতিরিক্ত আয়রন। ফলে পেটের অসুখ অধিকাংশ বসিন্দার নিত্যসঙ্গী। পিএইচই জলাধারগুলিতে আয়রন দূরীকরণ যন্ত্র বসানোর পাশাপাশি বিধি মেনে ক্লোরিন ও জীবানুনাশক ওষুধ জলে মিশিয়ে ট্যাপ কলের মাধ্যমে সরবরাহ করায় শহরবাসী ট্যাপের জলকেই পানীয় জল হিসাবে ব্যবহার করেন।

আবার পিএইচইর পাইপ লাইন থাকা সত্ত্বেও বছরের পর বছর ধরে পানীয় জল পাচ্ছেন না শহরের আরেক প্রান্ত ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের একাংশ বাসিন্দা। পরিস্রুত পানীয় জল না পেয়ে দুর্ভোগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন তারা। বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রায় ৯ বছর আগে বন্যার সময় জলের পাইপ ফেটে যায়। তারপর থেকে পুরসভা ও প্রশাসন কর্তৃপক্ষের কাছে বহু আবেদন করেও কাজ হয়নি। ওই এলাকার পুরসভার অধীন খিদিরপুর স্কুলপাড়া, দত্তপাড়া, হালদারপাড়া এলাকায় রাস্তার পাশে সার ধরে পানীয় জলের ট্যাপগুলি দাঁড়িয়ে। কিন্তু জল পড়ে না। পঞ্চায়েত ও পুরসভা থেকে বসানো কয়েকটি হস্তচালিত নলকূপের উপর ভরসা করেই এলাকার অন্তত ১০ হাজার বাসিন্দাকে পিপাশা মেটাতে হয় বলে বাসিন্দাদের দাবি। এলাকার বাসিন্দা আনন্দ দেব, সুজিত দেব, গৃহবধূ গীতা দত্ত, শীলা দত্তেরা আক্ষেপ করে বলেন, আমরা আত্রেয়ী নদীর ধারে বসবাস করি। অথচ জলকষ্টের মধ্যে দিন কাটাতে হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সমস্যার বিষয়ে জানানো হলেও জলের সমস্যা মেটেনি।

সীমান্তবর্তী জেলা সদর শহর বালুরঘাটের পানীয় জলের সমস্যা নিয়ে বিগত পঞ্চাশ বছরের উপাখ্যান ভাঙতে ২০০৮ সালে পুরভোটের মুখে আরএসপি পরিচালিত বালুরঘাট পুর কর্তৃপক্ষ বাসিন্দাদের বাড়িতে জল সরবরাহে তেড়েফুঁড়ে উঠেছিল। রাস্তা খুঁড়ে পিএইচইর পাইপ থেকে বাড়িতে সংযোগ করেছিল। বেশ কিছু এলাকায় মাসে ৪০ টাকা জলকর প্রদানের চুক্তিতে ২২১টি বাড়িতে পানীয় জল সরবরাহ করে সে সময় পুর কর্তৃপক্ষ বিতর্কের মুখে পড়েছিল বলে অভিযোগ। পিএইচই কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে ওই কাজ করায় পুর কর্তৃপক্ষের একাংশের বিরুদ্ধে জল চুরির অভিযোগ তুলেছিলেন তৎকালীণ পিএইচইর বাস্তুকারেরা। এরপর পিএইচই তরফে পুরসভাকে শহরের পানীয় জল সরবরাহের দায়িত্ব হস্তান্তর নিয়ে টানাপড়েন চলতে থাকে বলে অভিযোগ।

এর মধ্যে ২০১০ সালে কেন্দ্রের ইউপিএ সরকারের আমলে বাড়িতে পানীয় জল সরবরাহে জওহরলাল নেহরু আরবান রিনিউয়াল ওয়াটার মিশন প্রকল্পে বালুরঘাট পুরসভাকে প্রায় ৪২ কোটি টাকা দেওয়া হয়। ২০১২ সালে শহরের মঙ্গলপুরে জল শোধনের জন্য ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট তৈরির কাজ শুরু করে পাইপ সরবরাহের কাজও শুরু করে দেয় তৎকালীন পুর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ওই কাজ চলাকালীন ২০১৩ সালে পুরভোট চলে আসে। পানীয় জল সরবরাহকে প্রধান ইস্যু করে পুরভোটের প্রচার তুঙ্গে তুলে তৃণমূল বাজিমাত করে। ২০১৩ সালে বালুরঘাট পুরসভা বামেদের হাতছাড়া হয়ে ক্ষমতায় বসে তূণমূল। কাজ শুরু হয় বাড়িতে পানীয় জল সরবরাহ প্রকল্পের।

পুরসভার সূত্রের খবর, ইতিমধ্যে শহরের মঙ্গলপুর এলাকায় ট্রিটমেন্ট প্লান্টের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। খরচ হয়েছে ১২ কোটি ৩২ লক্ষ টাকা। আত্রেয়ীর কংগ্রেস ঘাটে নদী থেকে জলোত্তলনের জন্য ইনটেক পয়েন্টের কাজ সবে শুরু হয়েছে। খরচ ধরা হয়েছে ১২ কোটি ৪২ লক্ষ টাকা। এ ছাড়া মাটির নীচে বসানোর জন্য প্রায় ২০ কোটি টাকার পাইপ কিনে সংযোগের কাজ শুরু হয়েছে। তবে প্রকল্পটি রূপায়ণের সময় প্রায় চার বছর পিছিয়ে যাওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে প্রায় ৭৪ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে বলে মিউনিসিপ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং দফতরের (এমইডি) ইঞ্জিনিয়র সুদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘ইনটেক পয়েন্টটি তৈরির জন্য ৬ বার টেন্ডার করতে হয়েছে। একই সমস্যা হয়েছিল ট্রিটমেন্ট প্লান্ট তৈরির সময়।’’ ফলে খরচ বেড়ে যাওয়া ওই প্রকল্পটি শেষ করা নিয়ে স্বভাবতই চিন্তিত পুরকর্তৃপক্ষ থেকে বিভাগীয় ইঞ্জিনিয়ারেরা। তার উপর শহরে ট্যাপের মাধ্যমে পানীয় জল সরবরাহের দায়িত্ব পুরসভাকে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএইচই দফতর।

ফলে একদিকে বাড়িতে পানীয় জল পৌঁছনোর মতো গুরুতর কাজের পাশাপাশি রাস্তার ধারে চলতি ট্যাপ ব্যবস্থার মাধ্যমে শহরে পানীয় জল সরবরাহের দায়িত্ব কী ভাবে সামাল দেওয়া যাবে, পুরসভাকে ভাবিয়ে তুলেছে। ভাইস চেয়ারম্যান রাজেন শীল বলেন, পিএইচইর মতো কারিগরী সহায়তা পুরসভার নেই। পিএইচইর টেকনিক্যাল কর্মীদের পুরসভায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিষয়ে তহবিল চেয়ে রাজ্যে আবেদন করা হয়েছে। তবে এখনও ওই বিষয়ে রাজ্যের তরফে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি বলে জানা গিয়েছে।

বালুরঘাট পুরসভার হিসাবে শহরের ২৫টি ওয়ার্ডে জনসংখ্যা প্রায় দেড় লক্ষ। সেই মতো মাথাপিছু দৈনিক জল ব্যবহারের হিসাব ধরলে শহরে প্রতিদিন পুরসভাকে জলের যোগান দিতে হবে ১৮ লক্ষ ২৯ হাজার লিটার। অর্থাৎ প্রায় ৪ লক্ষ ৬ হাজার গ্যালন জল। গরমে আত্রেয়ী নদীর জল শুকিয়ে যায়। ফলে ওই প্রকল্পটি নিয়ে, কী ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে রূপায়িত হচ্ছে, তা জানতে সরব হয়েছে বিরোধীরা। জেলা কংগ্রেস সভাপতি নীলাঞ্জন রায়ের অভিযোগ, বামেদের গড়িমসির ফলে জল প্রকল্পটির খরচ দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে। বর্তমান শাসকদলও টেন্ডার দেওয়া নিয়ে কৌশল করায় বরাত প্রক্রিয়া দেরি হওয়ায় প্রকল্পটি ঝুলে গিয়েছে বলে নীলাঞ্জনের অভিযোগ। ইতিমধ্যে চলতি বছরের মার্চের মধ্যে জল প্রকল্পটির কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা পার হয়ে গিয়েছে। বাস্তবে প্রকল্পের অর্ধেক কাজ এখনও সম্পূর্ণ হয়ে ওঠেনি। তাই শহরের সম্পন্ন যারা, শহরে প্যাকেজিং ও ড্রামে সরবরাহ বেসরকারি সংস্থার পানীয় জল কিনে খাচ্ছেন। নিম্নবিত্ত সাধারণ শহরবাসীর ভরসা পুরনো আমলের পিএইচইর ট্যাপের জল কিংবা আয়রনযুক্ত নলকূপের ঘোলা জল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

North bengal Water project
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE