চার বছর আগে মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুরে মেয়েদের আন্তঃস্কুল রাজ্য ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতা হয়েছিল। গোটা রাজ্যের বিভিন্ন স্কুলের মেয়েদের ফুটবল দল তাতে অংশ নিয়েছিল। শুধু তাই নয়, জেলা মাদ্রাসা ক্রীড়া সংস্থার উদ্যোগে মাদ্রাসাগুলির মেয়েদের ভলিবল, খো খো, কবাডি ও ব্যাডমিন্টন দল কয়েক বছর ধরে রাজ্য স্তরের প্রতিযোগিতায় যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছে। এ বছরও আন্তঃজেলা মাদ্রাসা ভলিবল প্রতিযোগিতায় মালদহ রানার্স হয়েছে। জেলার আব্বাসগঞ্জ হাই মাদ্রাসার মেয়েরা কলকাতায় গিয়ে ফুটবলও খেলে এসেছে। এখন তারা ক্রিকেটও খেলছে। সেই মালদহে প্রশাসন মহিলাদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনায় জেলা স্কুল ও মাদ্রাসা ক্রীড়া সংস্থার পাশাপাশি ক্রীড়া মহলও ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত। ঘটনার জন্য সরাসরি প্রশাসনকেই দায়ী করেছেন তাঁরা। ঘটনাটি নিয়ে অবশ্য মুখে কুলুপ এঁটেছে প্রশাসন। শনিবার মালদহের জেলাশাসক শরদ কুমার দ্বিবেদী বলেছিলেন, “আইনশৃঙ্খলায় সমস্যা হতে পারে ভেবে ওই ম্যাচ বন্ধ করা হয়েছিল।” এ দিন নতুন করে আর কিছু বলতে চাননি তিনি।
গত শনিবার হরিশ্চন্দ্রপুরের চন্ডীপুরে জাতীয় মহিলা দলের একাধিক খেলোয়াড় নিয়ে তৈরি কলকাতা একাদশ ও উত্তরবঙ্গ একাদশের মধ্যে ওই প্রদর্শনী ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল। উদ্যোক্তা ছিল স্থানীয় প্রোগ্রেসিভ ইয়ুথ ক্লাব। কিন্তু আঁটোসাটো পোষাক পরে খেলা বা তা দেখা শরিয়ত বিরোধী বলে দাবি করে তা বন্ধ করার জন্য মৌলবীদের কয়েকজন বিডিও-র দ্বারস্থ হওয়ার পরে প্রশাসন ম্যাচ বন্ধ করে দেয়। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় তৃণমূল সদস্যাও। ওই ঘটনায় জেলা জুড়ে ক্রীড়া মহলে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। এ ছাড়া যে এলাকায় ওই ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল, জেলার মানচিত্রে সেই চণ্ডীপুরের আলাদা ঐতিহ্য রয়েছে। সেই সুনামে মোচড় ধরায় ব্যথিত বাসিন্দারাও। ব্যথিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উঠতি মহিলা ক্রীড়াবিদরাও। ঘটনার নিন্দায় সরব হয়েছে বঙ্গীয় বুদ্ধিজীবী বিকাশ মঞ্চ। যে প্রোগ্রেসিভ ইয়ুথ ক্লাবের উদ্যোগে ওই প্রদর্শনী ম্যাচের আয়োজন করা হয়, তাঁরা ব্লক প্রশাসনের কাছে তথ্য জানার অধিকারে ম্যাচ বন্ধের কারণ জানতে চেয়েছেন। তবে প্রশাসনের তরফে এখনও সে ব্যাপারে তাঁদের কিছু জানানো হয়নি বলে ক্লাব সূত্রে জানা গিয়েছে।
জেলা মাদ্রাসা ক্রীড়া সংস্থা জানিয়েছে, দেশের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ পড়ুয়াদের খেলাধুলোর প্রসারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তাঁর সময়েই রাজ্য এবং জেলা ও ব্লক স্তরে ক্রীড়া সংস্থা তৈরি হয়েছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে সংখ্যালঘু ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও যাতে খেলাধুলায় বেশি করে অংশ নেয়, সে জন্য মাদ্রাসা গেমস ও স্পোর্টসের পৃথক কাউন্সিল তৈরি করেছে।
জেলা মাদ্রাসা গেমস অ্যান্ড স্পোর্টস কমিটির যুগ্ম সম্পাদক সফিউর রহমান বলেন, “চন্ডীপুরের ঘটনা লজ্জাজনক। যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে এসব করছেন তাঁরা স্বার্থান্বেষী। সমাজকে তাঁরা পিছনে টেনে ধরতে চাইছেন। সেটা তো প্রশাসনকেই দেখতে হবে। মনে রাখতে হবে জেলায় আব্বাসগঞ্জ হাই মাদ্রাসার মেয়েরা ক্রীড়ায় প্রভূত উন্নতি করেছে। আর সেটা হয়েছে মাদ্রাসার সদ্য প্রাক্তন এক শিক্ষক হাজি সাহেব তাফাজ্জল হোসেনের জন্য।”
জেলা স্কুল ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক শুভেন্দু চৌধুরী মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরীর ভাই। তিনি বলেন, “রাজ্য সরকার যখন সব ক্ষেত্রেই মেয়েদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগী হচ্ছে, সেক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক।”
গত জানুয়ারিতেই মাদ্রাসার জেলা ভলিবল দলের হয়ে কলকাতায় খেলে এসেছে মহারাজপুর হাই মাদ্রাসার দুই ছাত্রী লালবানু খাতুন ও মানোয়ারা খাতুন। তারা এদিন জানায়, “আমরা রক্ষণশীল পরিবারে থাকি। কিন্তু বাড়িতে বরং খেলাধুলোয় উত্সাহ দেয়।”
বঙ্গীয় বুদ্ধিজীবী বিকাশ মঞ্চের উত্তরবঙ্গ কোর কমিটির সদস্য মুশারফ হোসেন বলেন, “ধর্মের জিগির তুলে খেলা বন্ধ করা হাস্যকর। মুসলিম মেয়েরা তো এখন বিমান চালাচ্ছে।”
হরিশ্চন্দ্রপুর থানার সব থেকে পুরনো স্কুলটি রয়েছে চন্ডীপুরে। ১৯১০ সালে স্কুলের প্রতিষ্ঠা করেন প্রয়াত পির সাহেব মৌলানা আবেদ হোসেন। ধর্মপ্রাণ ওই পির সাহেব ছিলেন মানবতার প্রতীক। ১০০ বছর আগেও এলাকার ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে স্কুল তৈরি করেন। ৫১টি গ্রামে পানীয় জলের কুয়ো খুঁড়েছিলেন। তাঁর স্মৃতিতে প্রতি বছর উরস পালিত হয়। তাঁর সমাধিতে আজও দুই সম্প্রদায়ের মানুষ শ্রদ্ধা জানাতে ছুটে যান। সেই চন্ডীপুরে ওই ঘটনায় ব্যথিত এলাকার মানুষ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy