Advertisement
E-Paper

আলুর দাম ঠিক করে অর্থনীতির হাসিকান্না

আর ১০টি বর্ধিষ্ণু শহরের মতো কংক্রিট গ্রাস করেছে ধূপগুড়িকে। পুরএলাকার মধ্যেই কুমলাই এবং বামনি নদীর পুরনো খাত ভরাটের অভিযোগ উঠেছে। জমিকে ঘিরে শুরু হয়েছে সিন্ডিকেট রাজ। বাসিন্দারা জানান, প্রতিদিন ঝড়ের গতিতে পাল্টে যাওয়া শহরের পিছনে রয়েছে আলু চাষ এবং ফাটকা কারবারকে ঘিরে বয়ে চলা কাঁচা টাকার স্রোত।

বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:০৯

আর ১০টি বর্ধিষ্ণু শহরের মতো কংক্রিট গ্রাস করেছে ধূপগুড়িকে। পুরএলাকার মধ্যেই কুমলাই এবং বামনি নদীর পুরনো খাত ভরাটের অভিযোগ উঠেছে। জমিকে ঘিরে শুরু হয়েছে সিন্ডিকেট রাজ। বাসিন্দারা জানান, প্রতিদিন ঝড়ের গতিতে পাল্টে যাওয়া শহরের পিছনে রয়েছে আলু চাষ এবং ফাটকা কারবারকে ঘিরে বয়ে চলা কাঁচা টাকার স্রোত। কিন্তু বাজারের দৈন্যদশা দেখে সিপিএমের কৃষক নেতা সুভাষ রায়ের মতো অনেকের মনে প্রশ্ন, যে ফাটকা কারবারের সিঁড়ি বেয়ে সমৃদ্ধিকে ছুঁয়ে দেখা, সেটার সাপলুডো ছকে অজগরের মুখে পড়ে সর্বনাশ দেখতে হবে না তো!

আলুর ফাটকা কারবার কাঁচা টাকা দিয়েছে। বিলাসিতা বেড়েছে। কিন্তু অর্থনীতির স্থায়িত্ব মিলেছে কি?

লাল চায়ে চুমুক দিয়ে আক্ষেপ করলেন ধূপগুড়ি চেম্বার অব কমার্সের সম্পাদক হিমাদ্রি সাহা। বললেন, “এ বার বিপদে পড়তে না হয়! কীসের বিপদ?”

হিমাদ্রিবাবু জানান, ধূপগুড়ির অর্থনীতি আলু নির্ভর। দাম ভাল থাকলে মুখে হাসি ফোটে আলুর। কাঁচা টাকা হাতে আসতে চাঙ্গা হয়ে ওঠে গাড়ি, সাইকেল, ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী, হার্ডওয়ার, কাপড়, প্রসাধনী থেকে মাছ বাজার -- সমস্ত ব্যবসা। কিন্তু যে বছর আশানুরূপ দাম মেলে না, গ্রাস করে মন্দা। ধূপগুড়ি মুখ থুবড়ে পড়ে। চিন্তান্বিত চা দোকানের মালিকও গালে হাত দিয়ে বলেন, “এ বার পরিস্থিতি ভাল ঠেকছে না। আলুর দাম নেই। কী হবে জানি না।”

কৃষি দফতরের পরিসংখ্যানে জানা গিয়েছে, ১৯৮৫ সাল থেকে ধূপগুড়িতে আলু চাষে ঝোঁক বাড়ে। ২০০২ সাল থেকে ব্লক জুড়ে সেটা ব্যাপক হারে শুরু হয়। গত এক দশকের মধ্যে ছবিটা আরও পাল্টে যায় এক কৃষি কর্তা জানান, জলপাইগুড়ি জেলায় গড় আলু চাষের এলাকা ২৫ হাজার হেক্টর। সেটা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার হেক্টর। ধূপগুড়ি ব্লকে এখন প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমি আলু চাষের এলাকা ধরা হয়। যদিও ২০০৩ সালে মাত্র পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হত। সরকারি হিসেবে এ বার চাষের এলাকা বেড়ে হয়েছে প্রায় ১২ হাজার হেক্টর। বেসরকারি হিসেবে তা অনেক বেশি।

কেন হিসেবের গরমিল?

চাষিরা বলছেন, নিয়ন্ত্রণের বাইরে আলু চাষ হয়েছে। তাই এই গরমিল।

চাষিদের দাবি, চিকিত্‌সক থেকে ঠিকাদার--- সবাই আছে এই ফাটকা কারবারে। কাঁচা টাকা রোজগারের স্বপ্নে ভেসে চাষির জমি লিজে নিয়ে আলু উত্‌পাদনে নেমে অনেকের ভরাডুবি হয়েছে। আবার অনেকে ফুলেফেঁপে উঠেছে। এমন অনিশ্চিত অর্থনীতির কথা ভেবে উদ্বিগ্ন ধূপগুড়ি ব্লক কৃষি আধিকারিক দেবাশিস সর্দার। তিনি বলেন, “কাঁচামাল কেন্দ্রিক অর্থনীতির স্থায়িত্ব নেই। অতি উত্‌পাদন হলে সর্বনাশ। সেই কারণে শস্য বৈচিত্র্য তৈরির চেষ্টা চলছে।”

কিন্তু শুনছে কে! বিপদ জেনেও প্রতি বছর আলু চাষের এলাকা বেড়ে চলেছে। প্রশ্ন উঠেছে---কেন আলুর নেশায় বিভোর এই শহর? পাট, তামাক টপকে কী ভাবে আলু গোটা অর্থনীতির চালিকা শক্তি হল?

উত্তরবঙ্গ আলু ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক কার্তিক দাস বলেন, “আলু চাষ বেড়ে চলার কারণ কাঁচা টাকার লোভ।” তিনি জানান, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের চাহিদার উপরে ধূপগুড়ি-সহ উত্তরবঙ্গের আলুর বাজার নির্ভরশীল। টানা কয়েক বছর সেখানকার বাজারে চাহিদা ভাল থাকায় এখন আলু চাষে লাভ হয়েছে। পরবর্তীতে সেখানেও আলু চাষ শুরু হয়। ফলে চাহিদা কমতে শুরু করেছে। এ বার চাহিদা অনেকটাই কম। সংস্থার সহকারী সম্পাদক শিবু চক্রবর্তী জানান, ভিন্‌ রাজ্যের চাহিদা ভাল থাকলে মরসুমে ধূপগুড়ি থেকে প্রতিদিন তিনশো ট্রাক আলু ভিন্‌ রাজ্যে যায়। প্রতি ট্রাকে চারশো কিলো আলু থাকে। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাস থেকে টানা ৭৫ দিন ব্যবসা চলে। ২২৫ কোটি টাকার লেনদেন হয়। এর বাইরে রয়েছে রেলপথে প্রায় ৭৫ কোটি টাকার আলুর কারবার। মরসুমে সব মিলিয়ে তিনশো কোটির আলু ব্যবসা হয়।

আলু চাষকে ঘিরে কর্মসংস্থানের ছবিও পাল্টেছে ব্লকের। চাষিদের অনেকে জমি লিজে দিয়ে নিজের জমিতে সপরিবারে মজুরি খেটে রোজগারের রাস্তা খুঁজে নিয়েছেন। এছাড়াও রয়েছে খেত থেকে আলু তোলা, প্যাকেটজাত করা, গাড়িতে তোলা। সব মিলিয়ে ব্লকের অন্তত ৮০ হাজার মানুষ আলু চাষ এবং আলুর ব্যবসাকে ঘিরে রোজগারের পথ করে নিয়েছে। কিন্তু বাজারে মন্দার আভাস মিলতেই চাষিদের মতো তাঁদের দিশেহারা দশা হচ্ছে। ধূপগুড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক দেবাশিস দত্ত বলেন, “ফাটকা কারবারের উপরে বেড়ে ওঠা অপরিকল্পিত শহরের ভবিষ্যত্‌ নিয়ে ভাবতে ভয় হয়। চিপস, পাউডার তৈরির মতো আলুভিত্তিক শিল্প স্থাপন প্রয়োজন ছিল। সেটা হয়নি। তাই তার ফল ভুগতে হচ্ছে।”

(চলবে)

potato price dhupguri biswajyoti bhattacharya amar shohor
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy