Advertisement
E-Paper

উঠে গিয়েছে স্কুল, হতাশা যৌনপল্লিতে

যৌনকর্মীর ঘরের কোণে আস্তাকুড়ে পড়ে রয়েছে লাল কালি দিয়ে লেখা ‘বিদ্যাসাগর সর্বশিক্ষা বিদ্যালয়’ টিনের সাইনবোর্ডটা। কিন্তু সেই সাইনবোর্ড দেখেও আর আশার আলো জাগে না শিপ্রা পাল সেনের মনে। স্কুলের প্রসঙ্গ তুললেই তিনি সাফ জানিয়ে দেন, “দয়া করে স্কুল নিয়ে কোনও কথা বলবেন না, এখানকার কচিকাঁচাদের নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। ছ’মাস স্কুল চালিয়ে বাড়ি ভাড়া না মিটিয়ে চলে গিয়েছে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও।”

নিলয় দাস

শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৫ ০২:১৪
এই ঘরগুলিতেই বসত স্কুল। ডান দিকে, পড়ে রয়েছে স্কুলের সাইন বোর্ড। —নিজস্ব চিত্র।

এই ঘরগুলিতেই বসত স্কুল। ডান দিকে, পড়ে রয়েছে স্কুলের সাইন বোর্ড। —নিজস্ব চিত্র।

যৌনকর্মীর ঘরের কোণে আস্তাকুড়ে পড়ে রয়েছে লাল কালি দিয়ে লেখা ‘বিদ্যাসাগর সর্বশিক্ষা বিদ্যালয়’ টিনের সাইনবোর্ডটা। কিন্তু সেই সাইনবোর্ড দেখেও আর আশার আলো জাগে না শিপ্রা পাল সেনের মনে। স্কুলের প্রসঙ্গ তুললেই তিনি সাফ জানিয়ে দেন, “দয়া করে স্কুল নিয়ে কোনও কথা বলবেন না, এখানকার কচিকাঁচাদের নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। ছ’মাস স্কুল চালিয়ে বাড়ি ভাড়া না মিটিয়ে চলে গিয়েছে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও।”

আলিপুরদুয়ার শহরের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে যৌনপল্লির ঘিঞ্জি ঘর, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, নিকাশি নালা কবে শেষ বার পরিষ্কার হয়েছিল, তা মনে নেই স্থানীয় বাসিন্দাদের। নর্দমার দুর্গন্ধ সন্ধ্যার আগে থেকে পাওয়া যায়। মদের পসরা বসে যায় রাস্তার ধারে। গালিগালাজ ভেসে আসে সর্বক্ষণই। আর সেই পরিবেশের মধ্যে বড় হচ্ছে গোটা পঞ্চাশেক কচিকাঁচা। তাদের মায়েরা যৌনকর্মী। বাইরের স্কুলে পড়তে গিয়ে কটূক্তি আর হেনস্তার শিকার হয়ে অনেকেই পড়া বাদ দিয়েছে। মাধ্যমিক পাশ করেছে মাত্র একজন।

কচিকাঁচাদের গঞ্জনার মুখে যাতে না পড়তে হয়, সে জন্য পাড়াতেই স্কুল চালু করতে উদ্যোগী হন যৌনকর্মীর মেয়ে শিপ্রা। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত তাঁর পড়াশোনা। মায়ের পেশায় না গিয়ে পানের দোকান চালিয়ে সংসার চালান। ২০০৫ সালে আলিপুরদুয়ার অভিভাবক মঞ্চ আর দুর্বার-এর সহযোগিতায় স্কুলের সূচনা হয়। এক যৌনকর্মীর থেকে ভাড়া নেওয়া দু’টি ঘরে সে সময় মিড ডে মিলের জন্য মহকুমাশাসক চাল বরাদ্দ করেছিলেন। তিন বছর চলার পরে আর্থিক সঙ্কটে পড়ে বন্ধ হয় স্কুলটি। স্কুল বন্ধের খবর প্রকাশ হবার পর ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে স্কুলটি চালু করার কথা জানায় স্থানীয় এক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ৩০ জন ছাত্রছাত্রী পড়ত সেখানে। তবে ছ’মাস না যেতেই ঘর ভাড়া বকেয়া রেখে স্কুলের খরচ দেওয়া বন্ধ করে দেয় ওই সংগঠন। সেই থেকে আজও স্কুলটি বন্ধ হয়ে পড়ে থাকলেও সরকারি দফতরে আবেদন নিবেদন করেও স্কুল চালু করতে কেউ উদ্যোগী হয়নি। গোটা পল্লি জুড়ে তাই হতাশা দেখা দিয়েছে। স্কুল আর চালু হবে না ধরে নিয়ে দুটি ক্লাস ঘর এখন দুই যৌন কর্মীর কাছে ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন ঘর মালিক। তাঁর কথায়, “আমার ঘর ভাড়া দিয়ে সংসার চলে। সেটাও না দিয়ে চলে গেল ওই প্রতিষ্ঠান। বাধ্য হয়ে যৌনকর্মীদের ঘর দু’টি ভাড়া দিয়েছি। তবে আমি চাই স্কুল হোক। কচিকাঁচারা মানুষ হোক। তা হলে আমি ফের ঘর ভাড়া দেব।”

এক যৌনকর্মীর কথায়, “আমার দুই সন্তান বড় হয়ে যেন মানুষের মত মানুষ হয়, সর্বক্ষণ সে প্রার্থনা করি। এখানে স্কুল হলে তাদের আর বাইরের স্কুলে গিয়ে কটূক্তি শুনতে হবে না।”

অপর এক যৌনকর্মীর আক্ষেপ, “আমাদের মতো কোনও মা কি চায়, মেয়ে আমার মতো যৌনকর্মী হোক? তবে আমার মেয়েকে পড়াশোনা করাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে ছিলাম। স্কুলের সহপাঠিনীরা মেয়েকে অন্য নজরে দেখত। কটূক্তি সহ্য করতে না পেরে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়ে পড়াশোনা ছেড়ে দেয় সে। এখানে স্কুল হলে বাচ্চারা অন্তত নিজেদের মতো করে পড়াশোনা করতে পারে।”

শিপ্রাদেবী বলেন, “অনেক যৌনকর্মী টাকার হিসেব রাখতে পারেন না। দুপুরে তাঁদের পড়াতাম। সকালে বাচ্চারা পড়ত। খুব আনন্দে কাটত তাদের। কিন্তু শেষ বার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ছেড়ে যাবার পর আমি মন থেকে স্কুলের চিন্তা দূরে সরিয়ে রেখেছি।” আলিপুরদুয়ার অভিভাবক মঞ্চের কর্তা ল্যারি বসুর কথায়, “সরকারের বিভিন্ন দফতরে ইতিমধ্যে আমরা যৌনপল্লিতে স্কুলের জন্য আবেদন করেছি। কোনও সাড়া মিলছে না। ছোট ছেলে মেয়েদের কথা ভেবে তাদের কিছু একটা করা দরকার।” আলিপুরদুয়ারের মহকুমা শাসক সমীরণ মণ্ডল এবং জেলা পরিষদের নারী ও শিশু কল্যাণ কর্মাধ্যক্ষ সর্বাণী দাস বিষয়টি দেখবেন বলে জানিয়েছেন।

niloy das alipurduar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy