Advertisement
E-Paper

ক্যানসার, দারিদ্রকে হারিয়ে লড়াই তিন কন্যার

ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে শরীরে। কিন্তু পাঞ্চালি রায়ের মন থেকে উপড়ে দিতে পারেনি ভাল কাজ করার ইচ্ছে। যেমন দারিদ্রের সঙ্গে নিত্য লড়াই করেও লোকশিল্পী শেফালি রায় ছাড়েননি ভাওয়াইয়া। সংসারের জোয়াল নিজের ঘাড়ে নিয়েও হস্তশিল্পে যেমন স্বপ্ন বোনেন অনিতা রাউত। জলপাইগুড়ির এই তিন কন্যাকে তাঁদের লড়াইয়ের জন্য কুর্নিশ করেন শহরের মানুষ।

অনিতা দত্ত

শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৫ ০২:১৭
পাঞ্চালি রায়, অনিতা রাউত, শেফালি রায় (বাঁ দিক থেকে)। —নিজস্ব চিত্র।

পাঞ্চালি রায়, অনিতা রাউত, শেফালি রায় (বাঁ দিক থেকে)। —নিজস্ব চিত্র।

ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে শরীরে। কিন্তু পাঞ্চালি রায়ের মন থেকে উপড়ে দিতে পারেনি ভাল কাজ করার ইচ্ছে। যেমন দারিদ্রের সঙ্গে নিত্য লড়াই করেও লোকশিল্পী শেফালি রায় ছাড়েননি ভাওয়াইয়া। সংসারের জোয়াল নিজের ঘাড়ে নিয়েও হস্তশিল্পে যেমন স্বপ্ন বোনেন অনিতা রাউত। জলপাইগুড়ির এই তিন কন্যাকে তাঁদের লড়াইয়ের জন্য কুর্নিশ করেন শহরের মানুষ।

পাঞ্চালি রায়ের এখন ক্যান্সারের স্টেজ থ্রি। কিন্তু দেখে বোঝার উপায় নেই। তিস্তা পারের কচিকাঁচা এবং পাড়ার বাচ্চাদের উৎসাহিত করে চলেছেন বছর ভর নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। জলপাইগুড়ি সেন্ট্রাল গার্লস উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যলায়ের পদার্থবিদ্যার শিক্ষিকা তিনি। ২০১২ সালের ২৭ এপ্রিল একা ছুটে গিয়েছিলেন কলকাতার নার্সিংহোমে। বায়োপসির বন্ডে স্বাক্ষর করেন নিজেই। তখনই জেনে যান, অসুখটার নাম ক্যান্সার। চেন্নাইতে গিয়ে বাদ দিতে হয় ওভারি-ইউটেরাস। পরে নিতে হয়েছে ১২টি কেমো এবং ১৪ বোতল রক্ত। লড়াই করেছেন পারিবারিক জীবনেও। বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য লড়াই চালিয়েছেন আট বছর। জলপাইগুড়ির হাকিমপাড়ার বাসিন্দা পাঞ্চালির শুরু হাকিমপাড়ার কচিকাঁচাদের নিয়ে, খোলা আকাশের নীচে। তিস্তা পারের ‘মুক্তমঞ্চে’ শিশু কিশোরদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মেতে উঠতেন পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই এই ‘তরুণী’। ২০১৪তে সহকর্মী শর্বরী সরকারের সঙ্গে গড়ে তুলেছেন ‘আনন্দলহরী’।

২৫ বৈশাখের প্রভাত ফেরিতে তাঁকে দেখা যায় সবার আগে। ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের নিয়ে প্রায় ৩ কিলোমিটার পথ পরিক্রমা। তারপরে সান্ধ্য অনুষ্ঠান। তাঁর কর্মসূচি থেকে বাদ পড়ে না নজরুল জয়ন্তী, বৃক্ষরোপণ। সম্প্রতি পালন করেছেন ভাষা দিবসও। সে কথা জানেন শহরের অনেকেই। যে ওয়ার্ডে পাঞ্চালি থাকেন, সেখানকার কাউন্সিলর স্বরূপ মণ্ডলের কথায়, “ভাবাই যায় না। জীবন ফুরিয়ে আসছে জেনেও কাজে তাঁর উৎসাহ যেন আরও বেশি। ওঁকে দেখে আমরাও উজ্জীবিত হই। আমাদেরও সামাজিক কাজকর্ম করতে হয়। কিন্তু ওঁর ব্যপারটা অন্য। এ ধরনের মানুষকে সরকারি তরফেও স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।”

শান্তিকেতনের ছাত্রী পাঞ্চালির বাবা সুশীলবাবু অধ্যাপনার কাজ করতেন। তাঁর লেখা বই জলপাইগুড়ি শিক্ষক শিক্ষণ মহাবিদ্যালায় এখনও পাঠ্যসূচিতে রয়েছে। নিজের যাবতীয় সঞ্চয়টুকুও দান করেছেন কলেজকেই। তাঁর মাকেও কেড়ে নিয়েছেন এই মারণ রোগই। তাতে কী? পাঞ্চালি বলেন, এক দিকে মাকে দেখে প্রেরণা পেয়েছি। আরেক দিকে আমার প্রেরণা রবীন্দ্রনাথ।”

শেফালির লড়াই দারিদ্রের সঙ্গে। কাটা কাপড় সেলাই করে সংসার চলে। অন্য সময় পরিচারিকার কাজ করেন। তিস্তাপারের সুকান্তনগর কলোনির বাসিন্দা শেফালিকে কিন্তু মানুষ চেনেন লোকশিল্পী বলেই। তিস্তার চরে একফালি টিনের ঘর। স্বামী জগদীশ রায় সাইকেল সারাইয়ের দোকান চালান। দুই মেয়েই বিবাহিত। সংসার থেকে ফুরসত মেলে শুধু রাতে। তখন সঙ্গী হারমোনিয়াম। ২০১০ সালে রাজ্য ভাওয়াইয়া প্রতিযোগিতায় পেয়েছেন দ্বিতীয় স্থান। উত্তরের মাটির সুবাস ছড়িয়েছেন বহরমপুর থেকে কল্যাণী, বেহালা থেকে মেদিনীপুর। তাঁর কথায়, “মঞ্চ, আলো, শ্রোতা সব ভুলিয়ে দেয় দুঃখ-কষ্ট-গ্লানি।” জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক জগদীশ রায়ের কথায়, “ওঁর গানে লোকসঙ্গীতের আন্তরিকতা রয়েছে। নিজে গায়, অন্যদেরও উৎসাহ দেয়।”

অনিতা রাউতের ছবিটা আলাদা। স্বামী দোকানের কর্মচারী ছিলেন। তাঁর কাজ চলে যাওয়ার পরে সংসারের জোয়াল চাপল তাঁর কাঁধে। বিয়ের আগে খেয়ালে শিখেছিলেন পাটের কাজ। এখন সেটাই জীবিকা। পাতকাটা কলোনিতে স্বামীকে মুদির দোকান করে দিয়েছেন তিনিই। ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। সমস্ত খরচ একার হাতেই সামলাতে হয়। দোকানেই তৈরি হয় পাটের চাবির রিং, হাতি, প্যাঁচা, পাপোশ, দোলনা সহ ঘর সাজানোর নানা সামগ্রী। প্রতিকূলতার মধ্যেও রাজ্য হস্ত শিল্প প্রতিযোগিতায় তাঁর হাতেই ওঠে পুরস্কার। এই সামগ্রী নিয়ে পাড়ি দেন রাজের বিভিন্ন প্রান্তে, রাজ্যের বাইরেও। পাঁচ জন মহিলা ইতিমধ্যেই তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বচ্ছল হয়েছেন। তিনি নিজেই জানালেন, “পাটের কাজই আমাকে লড়াইয়ের রসদ জুগিয়েছে।”

cancer poverty jalpaiguri anita datta
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy