Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ঘোড়া ছুটিয়ে ডাকাতদল আসত এখনকার শহুরে ফাঁসিদেওয়ায়

‘জোতে যাবি লিবে ডাকাইতে, পরাণ দিবি নগদা হাতে’! এক সময় এলাকার গ্রামে গ্রামে মানুষের মুখে ঘুরে বেড়াত এই ছড়া। সম্ভ্রান্ত কৃষক থেকে ছোট ব্যবসায়ী, বাদ পড়েননি অনেকেই। ঘন জঙ্গল থেকে পাথুরে রাস্তায় তির, বল্লম নিয়ে বার হয়ে আসত ডাকাত দল। কোনও কোনও সময় খটাখট শব্দে ঘোড়া সওয়ারি করেও সামনে এসে পড়ত ডাকাত দল। অবাধে চলত লুঠপাট। বাধা দিলেই যেত প্রাণ।

ফাঁসিদেওয়া বাজারে টাটকা শাক-সব্জি নিয়ে মহিলারা। ছবিটি তুলেছেন বিশ্বরূপ বসাক।

ফাঁসিদেওয়া বাজারে টাটকা শাক-সব্জি নিয়ে মহিলারা। ছবিটি তুলেছেন বিশ্বরূপ বসাক।

কৌশিক চৌধুরী
ফাঁসিদেওয়া শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৪ ০১:২৭
Share: Save:

‘জোতে যাবি লিবে ডাকাইতে, পরাণ দিবি নগদা হাতে’!

এক সময় এলাকার গ্রামে গ্রামে মানুষের মুখে ঘুরে বেড়াত এই ছড়া। সম্ভ্রান্ত কৃষক থেকে ছোট ব্যবসায়ী, বাদ পড়েননি অনেকেই। ঘন জঙ্গল থেকে পাথুরে রাস্তায় তির, বল্লম নিয়ে বার হয়ে আসত ডাকাত দল। কোনও কোনও সময় খটাখট শব্দে ঘোড়া সওয়ারি করেও সামনে এসে পড়ত ডাকাত দল। অবাধে চলত লুঠপাট। বাধা দিলেই যেত প্রাণ। দেহ কোনও সময় মিলত জঙ্গলের ধারে আবার কোনও সময় নদীর চরে। ‘ওপারে’ বাসিন্দারাও ছাড় পেতেন না। আর বাদ যাবেন না কেনই বা!

হিমালয়ের পাদদেশের তরাই-এর এই এলাকা দীর্ঘদিন ‘বন্দরগছ’ হিসাবে পরিচিত ছিল। মহানন্দী নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বন্দরকে ঘিরেও চলত ব্যবসা-বাণিজ্য। এদিকে তেঁতুলিয়া জেলার বির্স্তীণ এলাকা জুড়ে কাশিমগঞ্জ গ্রাম। অন্যদিকে বিহারের সূর্যাপূর অঞ্চল। বাকিটা জঙ্গল, বাঁশবন আর নানা ধরণের খেতে ঢাকা তরাই ভূমি। হাট, বাজার, ব্যবসা সব কিছুই বন্দরগছকে কেন্দ্র করে চলত। তবে সন্ধ্যা নামলেই বুনো জন্তুর হানার আশঙ্কা ছিল। ওই এলাকায় হরেকৃষ্ণ নাথ বা জুলুম সিংহের মত শিকারিদের হাতে ধরাও পড়েছে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার।

বন্দরগছ ধীরে ধীরে পাল্টে লোকমুখে হয়ে গিয়েছিল ফাঁসিদেওয়া। কথিত আছে, সেই সময় এই গোটা এলাকা সিকিম রাজার অধীনে ছিল। দেশের কোনও প্রান্তে রাজবন্দী বা ভয়ানক অপরাধীদের ঘোড়া বা গরুর গাড়িতে করে নিয়ে আসা হত বন্দরগছরের দক্ষিণ দিকের জঙ্গলে। সেখানকার কাঁঠাল, বট গাছে চলত আসামীদের ফাঁসির হুকুম তালিম। স্বাধীনতার বহু পরেও বৈশাখ মাসে মঙ্গলবার করে এলাকায় পুজো হত ‘ফাঁসিদেওয়া’ ঠাকুরের। শান্তির বার্তা হিসাবে উড়িয়ে দেওয়া হত সাদা পায়রা।

১৮৩৫ সালের পর ফাঁসিদেওয়া সিকিমের হাত থেকে ব্রিটিশদের হাতে চলে আসে। ধীরে ধীরে বন্ধ হতে থাকে ডাকাতি, ফাঁসির দণ্ডাদেশ। সেই জায়গায় খাজনা আদায়ের অন্যতম ‘পীঠস্থান’ হয়ে ওঠে দার্জিলিঙে বসবাসকারী ব্রিটিশ সাহেব’দের। খাজনা আদায়কারীদের জন্য গড়ে তোলা হয় আলাদা পাইকপাড়াও। শেষে ১৮৬৪ সাল নাগাদ বৃটিশ সরকার দার্জিলিং জেলা ঘোষণার সময় তরাই মহকুমার সদর দফতর হিসাবে ফাঁসিদেওয়ার নাম ঘোষণা করে। থানা-পুলিশ থেকে কাছারি-আদালত সবই ছিল ফাঁসিদেওয়ায়। গোটা দার্জিলিং জেলায় শৈলশহরের পর একমাত্র বড় শহর বলতে বোঝাত ফাঁসিদেওয়াকেই।

চাকা ঘুরতে শুরু করে ১৮৮০ সাল নাগাদ।

শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিংগামী রেল লাইন পাতা হয়। সমস্ত দফতর ফের তুলে আনা হয় প্রাচীন শিলিগুড়িতেই। শহুরে ফাঁসিদেওয়া পিছিয়ে পড়তে শুরু হয়। দেশভাগের জেরে যা ক্রমশ কোণঠাসাই হয়ে যায়। একদিকে বাংলাদেশ, অন্যপারে বিহার, উত্তর দিনাজপুর গঠন হয়। ত্রিকোণ কোণে আটকে ফের গ্রামের দিকেই ফেরা শুরু করে এই শহর। ফাঁসিদেওয়া হাইস্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক প্রবীণ আবদুস সাত্তার বলেন, “বাঘের ডাক থেকে ডাকাতদের গল্পই, কত কিছুই তো কথিত রয়েছে। নদীর ধারে তাঁবু ফেলে বিশাল হাট হত। দুই পারের মানুষ মিলে মিশে যেতেন। পরে তা বদলে যায়। আবার নতুন করে শুরু করেছে ফাঁসিদেওয়া। হয়ত বা আগামীদিনে নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়াবে।”

ফাঁসিদেওয়া যে নতুন করে শহুরে হচ্ছে, তা দাবি করেন এলাকার প্রবীণ, নবীন বাসিন্দাদের অনেকেই। চা বাগিচা থেকে বিনোদন পার্ক, আনারস খেত থেকে ফুড পার্ক। সবই হচ্ছে। একাধিক কলেজ থেকে পাকা শেডের হাট। কৃষিতেও বদলাচ্ছে ধরন। ধান, পাটের থেকে বার হয়ে স্ট্রবেরি, ব্রোকালির মত সব্জি চাষ হচ্ছে। ছোঁয়া লাগার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে পর্যটনেরও। যদিও ‘খামতি’ রয়েছে অনেক দিকেই। ফাঁসিদেওয়ার মিলনগড় হাই মাদ্রাসার শিক্ষক মহম্মদ আলি মুসা বলেন, “পাশে বাংলাদেশ থাকায় বিরাট ব্যবসা বাণিজ্য হতো। এখন তো সেই উপায়ও নেই। তাই কৃষি ভিত্তিক কল কারখানা, পর্যটন, বিনোদন এসবের ভিত্তি করে এগোতে হবে। কিছু হয়েছে। আরও দরকার।”

তবে এলাকার বহু বাসিন্দার চিন্তার কারণ আবার থেকেই যায় মহানন্দা নদী বরাবর কিলোমিটারের পর কিলোমিটার কাঁটাতারহীন সীমান্তকে ঘিরেও। উদ্বেগে থাকেন পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারাও।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

amar shohor kaushik chowdhury fashidaoa
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE