Advertisement
E-Paper

ঘরের দরজা খুলতে মনে হল উনুনের মধ্যে পড়েছি

মেঘালয়ের পাহাড়ি এলাকাতেই ছোট থেকে বড় হয়েছি। অনেকদিন ধরেই দার্জিলিঙের পাহাড় দেখার ইচ্ছে ছিল। তুরার একটি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতা করি। বড়দিনের ছুটি চলছে। সেই সুযোগে স্ত্রী-ছেলে আর শাশুড়িকে নিয়ে উত্তরবঙ্গে এসেছি। গত মঙ্গলবারই শিলিগুড়ি এসে পৌঁছই। বুধবার দার্জিলিঙের পথে রওনা দেওয়ার কথা ছিল। ভেবেছিলাম, সকলে মিলে পাহাড়ে ক’দিন থাকব। কিন্তু তার আগের রাতে আমাদের জন্য যা অপেক্ষা করে ছিল তা ভাবলেই এখনও শিউরে উঠছি।

শিবপ্রসাদ পি হাজম

শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৫ ০২:২৪

মেঘালয়ের পাহাড়ি এলাকাতেই ছোট থেকে বড় হয়েছি। অনেকদিন ধরেই দার্জিলিঙের পাহাড় দেখার ইচ্ছে ছিল। তুরার একটি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতা করি। বড়দিনের ছুটি চলছে। সেই সুযোগে স্ত্রী-ছেলে আর শাশুড়িকে নিয়ে উত্তরবঙ্গে এসেছি। গত মঙ্গলবারই শিলিগুড়ি এসে পৌঁছই। বুধবার দার্জিলিঙের পথে রওনা দেওয়ার কথা ছিল। ভেবেছিলাম, সকলে মিলে পাহাড়ে ক’দিন থাকব। কিন্তু তার আগের রাতে আমাদের জন্য যা অপেক্ষা করে ছিল তা ভাবলেই এখনও শিউরে উঠছি।

সকালে উঠে বের হতে হবে, সে জন্য মঙ্গলবার রাতে তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়ে পরি। তখন রাত কটা বাজে জানি না। খুব জোরে দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যায়। কেউ একটা নাগাড়ে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। প্রথমে মনে হয়েছিল হোটেলে ডাকাত পড়েছে বুঝি। তাই দরজা খুলিনি। কিন্তু সকলের চেঁচামেচি শুনে, দরজা খুলতেই মনে হল যেন কোনও উনুনে ঢুকে পড়েছি। একটা অসহ্য গরম হলকা চোখে-মুখে লাগল, বাইরে কালো ধোঁয়া পাকিয়ে উঠছে, নাকে একটা কটূ গন্ধ। কয়েক মুহূর্তের জন্য হাত-পা অসাড় হয়ে আসে। বোধ-বুদ্ধিও যেন হারিয়ে ফেলেছিলাম। হঠাত্‌ই কেউ একজন দৌড়ে এসে বলেন, “আরে ভাগিয়ে, আগ লাগ গায়া।’’

ঘরের ভিতরে স্ত্রী, ছেলে, শাশুড়ি রয়েছেন। ওদের যে ডাকব সে ক্ষমতাও নেই। ভয়ে আতঙ্কে গলা দিয়ে আওয়াজও বের হচ্ছিল না। হোটেলের তিন তলায় আমাদের ঘর। কালো ধোঁয়ায় সিড়ি ঢেকে গিয়েছি। গায়ে প্রচন্ড তাপ এসে লাগছে। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। শাশুড়িও দ্রুত চলাফেরায় সমস্যা রয়েছে।

সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না। তবে, যাতে কোনও ভাবে ঘরে আগুন না ছড়িয়ে পড়ে তার ব্যবস্থা করতে হবে। দৌড়ে ঘরে ঢুকে সকলকে ডেকে তুলি। ততক্ষণে ঘরটাও গরম হতে শুরু করেছে। বাথরুমে ঢুকে সব কটা কল খুলে দেই। বালতি গামলা এমনকী মগে করে জল অনে ঘরের চারদিকে ছেটাতে থাকি। ঘরের দেওয়ালেও জল ছেটাই। বেশ কিছুক্ষণ জল ছেটানোর পরে দু’হাত টনটন করতে থাকে। আর পারছিলাম না। ঘরের সবাইকে বাথরুমে ঢুকিয়ে দেই। হঠাত্‌ই লক্ষ্য করি, দরজার নীচ দিয়ে ধোঁয়া ঢুকতে শুরু করেছে। বুঝতে পারি, কিছুক্ষণের মধ্যেই গোটা ঘরটাই ধোঁয়ায় ভরে যাবে।

বিপর্যয়ের আরও বাকি ছিল। হঠাত্‌ই ঘরের আলো নিভে যায়। শীরদাড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে আসে, মনে হয় যেন, অন্ধকার ঘরে সকলে মিলে দমবন্ধ হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করে চলছি। তখনই মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়। ধোঁয়া যাতে বের হতে পারে, সে কারণে বাথরুমের জানলা খুলে দেই। নীচে তখন দমকলের সাইরেন বেজেই চলছে। বাথরুমের জানালা দিয়েই ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে চিত্‌কার করি, কিন্তু কেউ শুনতে পারছে বলে মনে হয়নি। কতক্ষণ এভাবে কেটেছে বলতে পারব না। এক এক মিনিট যেন ঘণ্টারও বেশি সময়। কিছু পরে বাইরের চেঁচামেচি কিছুটা শান্ত মনে হয়। মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে সাহস করে দরজা খুলি। বুঝতে পারি, বাইরে ধোঁয়াও তখন অনেকটাই কমে এসেছে, তবে গরম ভাবটা তখনও আছে। এমন সময়ে টর্চের আলো দেখতে পাই। সেই আলোটা ক্রমশ কাছে আসে। দেখলাম হেলমেট মাথায় এক দমকল কর্মী হাত বাড়িয়ে ডাকছেন। আর, দেরি করিনি। সকলে নিয়ে দমকল কর্মীদের সঙ্গে নীচে নেমে আসি।

তিন তলা থেকে অন্ধকারে নেমে আসার সময়ে বৃদ্ধা শাশুড়ির পায়ে জখম হয়েছে। সে যাই হোক, সকলে মিলে প্রাণে বাঁচতে পেরেছি এটাই শেষ কথায়। বলতে পারেন, নতুন বছরে নতুন জীবন ফিরে পেলাম।

fire hotel shibprasad p hazam
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy