বহু ফ্ল্যাট হচ্ছে শিবমন্দিরে। তবে পরিষেবা নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।
শিবমন্দির এলাকার সমস্যা কেন মেটে না বা উন্নয়ন কেন হয় না তা নিয়ে শাসক ও বিরোধী দলের তরজা নতুন কিছু নয়। বাম আমলে তৃণমূল অভিযোগ করেছে। ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পরে বামেরা এখন তিন বছর ধরে রাজ্য শাসনের দায়িত্বে থাকা তৃণমূলের উপরে দায় চাপানোর চেষ্টা করছে। শিবমন্দিরের ভুক্তভোগী বাসিন্দারা কিন্তু নেতা-কর্তাদের আশ্বাস, চাপানউতোর নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতে চান না। বরং বাসিন্দারা সম্মিলিত উদ্যোগে এলাকার নানা কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার চেষ্টা করে চলেছেন।
প্রাচীন শিবমন্দিরটির কথাই ধরা যাক। যে মন্দিরের জন্য আঠারোখাইয়ে ওই এলাকাটি শিবমন্দির হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। প্রয়াত কালীপ্রসাদবাবুর উদ্যোগে তৈরি ওই মন্দিরের সঙ্গে তাঁর পরিবারের সদস্য-সদস্যারা এখনও ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত। ফি বছর ধূমধাম করে সেখানে পুজোও হয়। তখন ছোটখাট মেলার আকার নেয় শিবমন্দির এলাকা। তবে সবচেয়ে বড় মেলা হয় দুর্গাপুজোর পরে। আঠারোখাই স্কুলের মাঠের সেই শারদীয়া সম্প্রীতি মেলায় অংশ নেন এলাকার সকলেই। এখন গ্রাম পঞ্চায়েতই ওই মেলা পরিচালনা করে থাকে। একটা সময় পর্যন্ত সরোজিনী সঙ্ঘই ছিল মেলার উদ্যোক্তা। শিবমন্দির এলাকার ঐতিহ্যের কথা উঠলে সরোজিনী সঙ্ঘের নাম আসবে। এলাকার এই পুরানো ক্লাবকে ঘিরেই স্থানীয় খেলাধূলো-সহ নানা কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে।
তবে এলাকার বাসিন্দাদের অনেকেরই অভিযোগ, শিলিগুড়িতে খেলাধূলার বিকাশে যে ভাবে নানা সরকারি উদ্যোগ দেখা যায় তার ভগ্নাংশও আঠারোখাইয়ের জন্য বরাদ্দ হয় না। শিবমন্দির এলাকায় প্রচুর ফাঁকা জায়গা থাকলেও ইনডোর স্টেডিয়াম তৈরির কথা ভাবা হচ্ছে না কেন, সেই প্রশ্নও ক্রীড়াপ্রেমীরা তুলেছেন। অথচ শিলিগুড়ির গা ছুঁয়ে থাকা শিবমন্দিরে মাঝারি মাপের খেলার আয়োজনের ব্যবস্থা থাকলে দুটি এলাকা লাভবান হতো। একদিকে, শিলিগুড়িতে যে পার্কিংয়ের সমস্যা রয়েছে তা শিবমন্দিরে নেই। দ্বিতীয়ত, ওই ধরনের আয়োজন হলে খেলাধূলার প্রসারের সঙ্গে এলাকার অর্থনীতিও আরও শক্তপোক্ত হতো।
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী এখন শিবমন্দিরেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। তঁদের কয়েকজনের অভিযোগ, বাম আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা কাজে আসা মন্ত্রী-আমলাদের বহুবার এলাকার সমস্যা ও সম্ভাবনার ব্যাপারে জানানো হলেও লাভ হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মী আক্ষেপের সুরে বলেন, “পাঁচ দশক আগে যা জনসংখ্যা ছিল তা কয়েক গুণ বেড়ে এখন ৫০ হাজার জনের বসবাস। অথচ পরিষেবার মান বাড়ানোর দিকে কারও নজর নেই। ছোট্ট একটা দৈনন্দিন প্রয়োজনের কথা জানানো যাক। তা হল, আজও গোটা শিবমন্দিরে মাত্র একটাই রান্নার গ্যাসের ডিলার। ফলে, মাঝেমধ্যে গ্যাস সিলিন্ডার পেতে নাকানিচোবানি খেতে হয়। মন্ত্রী-আমলারা এই ছোট্ট কাজটা করে দিতে পারেন না!” ঘটনাচক্রে, শিবমন্দির এলাকার কাছেই রয়েছে ইন্ডিয়ান অলে কর্পোরেশনের সদর দফতর। সেখানকার একজন পদস্থ কর্তা জানান, শিবমন্দির এলাকার বাসিন্দাদের আর্জি বিবেচনা করে পদক্ষেপ করা হবে।
বস্তুত, অবস্থানগত কারণেই শিবমন্দির এলাকায় জনবসতি ক্রমে বাড়ছে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রধান রথীন বন্দ্যোপাধ্যায় অন্তত তেমনই মনে করেন। তিনিও এখন পাকাপাকি ভাবে শিবমন্দির এলাকার বাসিন্দা। দীর্ঘ সময় এলাকায় থাকার সুবাদে তাঁর নজরে পড়েছে অনেক সমস্যা ও সম্ভাবনাই। যেমন, এলাকায় যথেচ্ছ নির্মাণ হওয়ার বিষয়টি নিয়ে বারেবারেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি। কারণ, কোথাও জনবসতি বাড়লে সমানুপাতিক হারে নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা থাকা জরুরি। রথীনবাবুর কথায়, “চাহিদা রয়েছে বলেই ফ্ল্যাটের সংখ্যা বাড়ছে শিবমন্দির এলাকায়। কিন্তু, নিকাশি, পানীয় জল, রাস্তা, খেলাধূলার জায়গা, পার্ক যাতে থাকে সে দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে না।” কেন আজও বিশ্ববিদ্যালয় ও লাগোয়া এলাকায় পরিস্রুত পানীয় জল বাড়ি বাড়ি পৌঁছনোর ব্যবস্থা হয়নি সেই প্রশ্নও তুলেছেন রথীনবাবু-সহ অনেকেই। তাঁদের কথায়, “এলাকাটা দস্তুরমতো শহুরে হয়ে গিয়েছে। কিন্তু, দৈনন্দিন নাগরিক পরিষেবার হাল দেখে মনে হয়, এটা না গ্রাম, না-শহর। এভাবে দীর্ঘদিন চলতে পারে না।” উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতর, শিলিগুনি জলপাইগুড়ি ডেভেলপমেন্ট অথরিটির পক্ষ থেকে ওই এলাকার নানা চাহিদা মেটানোর পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। সেই মতো পদক্ষেপও করা হচ্ছে বলে সংস্থার তরপে কর্তাদের অনেকেই দাবি করেছেন।
বাস্তব ছবিটা কেমন? শিবমন্দির লাগোয়া এলাকায় ছোটদের জন্য পার্ক তৈরির কাজ এখনও হয়নি। নিকাশির হাল ফিরিয়ে এলাকার জল হাইড্রেনের মাধ্যমে লাগোয়া নদীতে ফেলার পরিকল্পনাও ফাইল বন্দি হয়ে রয়েছে। এসজেডিএ-এর বর্তমান চেয়ারম্যান তথা উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব অবশ্য দাবি করেছেন, আঠারোখাই এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার, সুষ্ঠু নাগরিক পরিষেবা দেওয়ার লক্ষ্যে এসজেডিএ একগুচ্ছ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কিছু কাজও শুরু হয়েছে।”
এসজেডিএ-র ওই সব প্রকল্পের সুফল শিবমন্দির এলাকার বাসিন্দা কবে পাবেন সেটাই বড় প্রশ্ন। সেই সঙ্গে বাম আমলে যা ‘হচ্ছে-হবে’ করেও হয়নি, সেই আঠারোখাই পুরসভা গঠন তৃণমূল জমানায় হয় কি না সেটাও দেখার বিষয়।
(শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy