বাস শেড নেই। ঝড় জল, রোদে, ঠান্ডায় ফুটপাতের ধারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয় যাত্রীদের। নিজস্ব চিত্র।
এখন উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থার আলিপুরদুয়ার ডিপোয় মোট বাসের সংখ্যা ৪৮টি। তাও সব ক’টি রাস্তায় নামার মতো অবস্থায় নেই। ডিপো সূত্রের খবর, ৮টি বাস বিকল হয়ে গ্যারাজে রয়েছে। বাকি ৪০টির মধ্যে অর্ধেকই নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। প্রতি মাসেই পুরানো গাড়ির নানা যন্ত্রাংশ বিকল হয়ে পড়ে। অনেক সময়ে মাঝ রাস্তায় গাড়ি বিকল হয়ে পড়ার ঘটনাও অতীতে ঘটেছে। নিত্যযাত্রীদের দাবি, জেলা সদরের অন্যতম এই ডিপোয় নতুন বাস দিতে হবে। ইতিমধ্যেই জেএনআরইউএম-এর আওতায় যে সব বাস উত্তরবঙ্গে আনা হয়েছে, তার কয়েকটিকে আলিপুরদুয়ারে দেওয়ার আর্জি জানিয়েছেন ডিপো কর্মীরা।
অবশ্য শুধু বাস পেলেই সমস্যা মিটবে না। গোটা আলিপুরদুয়ার শহরে পরিকল্পিত কোনও বাস শেড নেই। ঝড়জল, রোদে, ঠান্ডায় ফুটপাতের ধারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয় যাত্রীদের। আলিপুরদুয়ার বাটা মোড়ের কাছে জলপাইগুড়ি বাসস্ট্যান্ড অথবা শোভাগঞ্জ এলাকায় মনোজিত্ নাগ বাসস্ট্যান্ডের অবস্থাও খুব একটা ভাল নয়। জলপাইগুড়ি বাস স্ট্যান্ডটিতেও কোনও যাত্রী শেড নেই। বর্ষাকালে জমা জল ও কাদা পেড়িয়ে যাতায়াত করতে হয় যাত্রীদের। মনোজিত্ নাগ বাসস্ট্যান্ডে যাত্রী শেড রয়েছে। তবে তা এতটাই উঁচুতে যে বর্ষায় জলের ঝাপটায় ভিজতে হয় যাত্রীদের। সেখানে অনেক গাড়ি ঢোকে না বলে অভিযোগ। দোতলা যাত্রী প্রতীক্ষালয়ের অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে বেহাল।
অথচ কোচবিহারের রাজার আমলে আলিপুরদুয়ারে বাস পরিষেবার মান ছিল তুলনামূলক ভাবে অনেক ভাল। বাস পরিষেবাও চালু করেছিলেন কোচবিহারের মহারাজারা। পরে রাজ আমলের বাস পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাটিকে পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থা অধিগ্রহণ করে। উত্তরবঙ্গের জন্য আলাদা নাম হয় উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থা। রেল পথে দূরে দূরান্তে যাতায়াত করলেও ডুয়ার্সের বিভিন্ন এলাকায় যোগাযোগের অন্যতম উপায় ছিল সরকারি বাস।
ষাটের দশকে আলিপুরদুয়ারে তৈরি হয় বাস ডিপোটি। বক্সা বনাঞ্চলের মধ্যে দিয়ে জয়ন্তী নদীর সেতু পেরিয়ে হাতিপোতা ময়নাবাড়ি হয়ে রায়ডাক নদী পার করে বাস চলত কুমারগ্রাম পর্যন্ত। তা ছাড়া, কালচিনি, ফালাকাটা, কোচবিহার, জয়গাঁ, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি রুটে বাসই ছিল স্থানীয় বাসিন্দাদের ভরসা। ১৯৯৩ সালের বন্যায় জয়ন্তী নদীর সেতু ভেঙে যাওয়ার পরে তা আর তৈরি হয়নি। ফলে, ওই রুটে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পরে কলকাতা, বিহারের মতিহারি সহ নানা জায়গায় শুরু হয় বাস পরিষেবা। সেই সময় স্থানীয় রুটগুলিতে বেসরকারি উদ্যোগে বাস চালাতে হলে অনুুমোদন নিতে হত উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থার। অনুমতি মিললে তবেই সেই সব রুটে চালানো যেত বেসরকারি বাস পরিষেবা।
বাস বিকল হওয়ায় ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে এনবিএসটিসি-র নানা রুটের বাস পরিষেবাও বন্ধ হয়েছে। সেন্ট্রাল ডুয়ার্স, টোটোপাড়া, রায়ডাক চা বাগান রুটে বাস বন্ধ। অসমের বঙ্গাইগাঁও ও তেজপুরে বাসও বন্ধ। কুমারগ্রামের সংকোশ বস্তি বা বক্সা পাহাড়ের সান্তালাবাড়িতে চলে সাপ্তাহিক বাস। কলকাতা ও নবদ্বীপের বাস পরিষেবাও দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে বন্ধ। বিহারের ছাপড়া ও ঝাড়খন্ডের রাঁচি পর্যন্ত আলিপুরদুয়ার ডিপো থেকে চলত বাস। কয়েক বছর আগে তা-ও বন্ধ করে দিয়েছে এনবিএসটিসি। আলিপুরদুয়ার ডিপোর ইনচার্জ অসিত ঠাকুর বলেন, “নতুন করে কিছু রুটে বাস দেওয়া হয়েছে।”
আলিপুরদুয়ার জংশন থেকে চিকিত্সা, শিক্ষা সহ নানা কাজে নিয়মিত শিলিগুড়ি যেতে হয় বাসিন্দাদের অনেকেরই।
আলিপুরদুয়ার জংশন থেকে ট্রেনে শিলিগুড়ি যেতে সময় লাগে প্রায় চার ঘন্টা। তা-ও ভোরের দিকে ও বিকেলে ট্রেন। তা ছাড়া দিনের বাকি সময় ভরসা বাস বা ভাড়া গাড়ি। আলিপুরদুয়ার থেকে জলপাইগুড়ি বাস পরিষেবা থাকলেও সরাসরি ট্রেন নেই। নিউ আলিপুরদুয়ার থেকে জলপাইগুড়ি রোডে নেমে সড়ক পথে যেতে হয়। সে জন্য এনবিএসটিসিকে জেলা সদরের বাসিন্দাদের যোগাযোগ সুগম করতে বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে বলে মনে করেন ভুক্তভোগীরা।
উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থার ডিরেক্টর তথা তৃণমূলের জেলা সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তী নিজেও আলিপুরদুয়ারের ভূমিপুত্র। তিনিও শহরের যাত্রী পরিষেবার বেহাল দশার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে তিনি বাম আমলে শহরের দিকে নজর দেওয়া হয়নি বলেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। গত তিন বছরে সৌরভবাবুরা কী করলেন? জবাবে তিনি অনেক পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। যেমন, আলিপুরদুয়ার ডিপোটি অত্যাধুনিক ভাবে সাজা হবে।
বাস দাঁড়ানোর লেন, যাত্রী প্রতীক্ষালয়, রেস্তোরাঁ, পর্যটকদের কেনাকাটার জন্য দোকান, যাত্রী নিবাস তৈরি হবে। সম্প্রতি আলিপুরদুয়ার বীরপাড়া থেকে জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার থেকে ফালাকাটা হয়ে জলপাইগুড়ি দুটি বাস সার্ভিস চালু করা হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। আলিপুরদুয়ার থেকে কলকাতা যাওয়ার জন্য দুটি ভলভো বাস কেনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেছেন।
সৌরভবাবু অবশ্য অভিযোগ করেছেন রেলের বিরুদ্ধে। তাঁর বক্তব্য, আলিপুরদুয়ার থেকে নতুন ট্রেন চালু করার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও রেল কর্তৃপক্ষ তা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। ট্রেন নিয়ে অবশ্য আলিপুরদুয়ারের নানা মহলেরও দাবি রয়েছে।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy