দার্জিলিং ম্যালে পর্যটকদের ভিড়। সোমবার রবিন রাইয়ের তোলা ছবি।
সাত সকালে হাতে গড়া শেল রুটি এবং পাহাড়ি আলুর দম। দুপুরে দেশি মুরগির মাংস আর রাইশাক। কখনও আবার খেতের থেকে তুলে আনা সতেজ বাধাকপির সব্জি এবং ডোলের (স্থানীয় লাল লঙ্কা) আচার। ছোট্ট টিনের চাল এবং কাঠের ঘরে বসে বই পড়া বা গান শোনার ফাঁকেই জানলা দিয়ে পাহাড়ের উকিঝুঁকি। মন ভাল করতে পাহাড়ের আঁকাবাকা চড়াই উতরাই ধরে একটু হেঁটে আসা। আর যে কোনও সময় দরকারে হাজির আতিথেয়তায় ভরা পাহাড়ি মানুষগুলি। এ বারের পুজোর পর্যটন মরসুমে এই সব ‘অফবিট ডেস্টিনেশনই’ বেশি করে মন টানল বাঙালি পর্যটকদের। বাদ যাননি ভিন্ রাজ্যের অবাঙালিরা পর্যটকেরাও।
দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং এবং মিরিকে ক্লান্তিহীনভাবে ঘুরতে পছন্দ করা বাঙালি ‘হোমস্টে’র স্বাদকে এ বার পুজোয় পুরোদস্তুর উপভোগ করছেন। পর্যটন দফতর এবং বেসরকারি পর্যটন সংস্থাগুলির হিসাব বলছে, পাহাড়ে মূল চারটি শহর লাগোয়া বিভিন্ন হোমস্টেতে এ বার তিলধারণের জায়গা ছিল না। সকলেরই আশা, দীপাবলির মরশুম অবধি পর্যটকদের এই আনাগোনা থাকবে। বিশেষ করে রাজনৈতিক অস্থিরতা শূন্য পাহাড়ের বর্তমান ‘শান্ত পরিবেশে’র জন্যই এই ভিড় বলে পর্যটন ব্যবসায়ীরা মনে করছেন। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ অবধি অবস্থা এমনই চলবে বলে পর্যটন ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
ওই ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, পেডং, আলগাড়া, লাভা, চটকপুর, সিলারিগাঁও, রিশি, কোলাখাম, চিমণি, বাগোড়া, লাটপাঞ্চার, তাকদা, লামাহাটা, তিনচুলা, সুখিয়াপোখরি-মত এলাকার হোমস্টেগুলিতে এ বার পর্যটকদের ভিড় উপচে পড়েছে। মিরিক লেক লাগোয়া নতুন হোমস্টেগুলিতেও পর্যটকেরা গিয়েছেন। পাহাড়ের পাশাপাশি সেন্ট্রাল ডুয়ার্সের বক্সার রায়মাটাং, জয়ন্তী, লেপচাখা, বক্সাদুয়ারেও এসেছেন প্রচুর পর্যটক।
সরকারি সূত্রের খবর, গত জুলাই মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ অবধি দেশের ছ’টি বড় শহরে পর্যটন মন্ত্রকের তরফে পর্যটন প্রসারে রোডশো হয়েছে। পুণে, আহমদাবাদ, দিল্লি, হায়দরাবাদ, চেন্নাই ও বেঙ্গালুরুতে রোড-শোগুলি হয়। সেখানে অন্য রাজ্যের পাশাপাশি রাজ্য পর্যটন দফতর রাজ্যকে তুলে ধরা ছাড়াও পাহাড়ের হোমস্টেগুলিকে নিয়ে আলাদা প্রচারও করা হয়। রাজ্য পর্যটন দফতরের যুগ্ম অধিকর্তা (উত্তরবঙ্গ) সুনীল অগ্রবাল বলেন, “আমরা এলাকাগুলির সামাজিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ওই প্রচার করেছি। আমাদের ওয়েবসাইটে হোম স্টে-র বিবরণও পর্যটকদের সুবিধার জন্য তুলে ধরা হয়।”
দার্জিলিং, কালিম্পং শহরে দু’য়েক দিন থেকেই পর্যটকেরা পৌঁছে গিয়েছেন গ্রামগুলিতে। ইস্টার্ন হিমালয়া ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের কার্যকরী সভাপতি সম্রাট সান্যাল বলেন, “দার্জিলিঙে তিল ধারণের জায়গা নেই। তবে সেই সঙ্গে এ বারই হোমস্টেগুলিও ভিড়ে উপচে পড়েছে। ছোট ছোট গ্রামগুলিতে থেকে পাহাড়ের সৌন্দর্য্য উপভোগ করেছেন।” অ্যাসোসিয়েশন ফর কনজারভেশন অ্যান্ড ট্যুরিজমের তরফে রাজ বসু বলেন, “আমরা পর্যটনের সঙ্গে জড়িতরা প্রায় এক দশক ধরে এই এলাকাগুলিকে তুলে ধরা চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি। এ বার তা অনেকটাই সফল হয়েছে।”
তবে বাদ যায়নি ‘কুইন অব হিলসও’। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি তিলধারণের জায়গা মিলছে না ম্যাল চৌরাস্তাতেও। শহরের বেশিরভাগ হোটেলের ঘর, গাড়ির বুকিং পাওয়া পুজোর পরেও সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামী নভেম্বর মাসে দ্বিতীয় সপ্তাহ অবধি এই পরিস্থিতি থাকবে বলে পাহাড়ের পর্যটনের সঙ্গে জড়িতরা জানিয়েছেন। দার্জিলিং অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস-এর সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ লামা বলেন, “প্রতিটি হোটেল, লজ ভর্তি। আগামী ১০ অক্টোবরের পর কয়েকদিন একটু হালকা রয়েছে। তার পরে দীপাবলি অবধি সব বুকিং হয়ে গিয়েছে। প্রতিদিন বুকিং-এর ফোন আসছে। কিন্তু ঘর বা জায়গা নেই।”
পর্যটকদের ঢল পাহাড়ে নামায় খুশি হোটেল ব্যবসায়ীরাও। দার্জিলিঙের একটি হোটেলের ম্যানেজার দেবীপ্রসাদ সরকার বলেন, “আমার হোটেলের সব ঘর নভেম্বর অবধি বুকিং হয়ে রয়েছে। এই সময়টা মূলত বাঙালি পর্যটকেরাই বেশি আসছেন। দীপাবলির সময় থেকে গুজরাত এবং রাজস্থানের পর্যটকেরা আসা শুরু করবেন।” হোটেল বা পর্যটন ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি দম ফেলার সময় পাচ্ছেন না গাড়ির মালিক ও চালকেরাও। লোয়ার ক্লাবসাইড ড্রাইভার্স অ্যাসোসিয়েশনের তরফে নবীন গুরুঙ্গ বলেন, “পুজোয় এবারেও পাহাড় পর্যটকে ভরে গিয়েছে। স্ট্যান্ডের ৬০টি গাড়ি প্রতিদিন বুক থাকে। আরও গাড়ি থাকলে ভাল হত। প্রতিদিনই চাহিদা ক্রমে বাড়ছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy