Advertisement
E-Paper

পড়ার তাগিদেই পাম্পে কাজ দুই তরুণীর

দু’জনেই পড়তে চান। দু’জনেরই বাধা পরিবারের অবস্থা। ডুয়ার্সের মালবাজারের ডামডিম চা বাগানের দুই কিশোরী প্রিয়া ও কালিস্তার মধ্যে ছোটবেলা থেকেই বন্ধুত্ব। দারিদ্রকে হারিয়ে পড়ার তাগিদে জোট বেঁধেছেন দুই বান্ধবী। যোগ দিয়েছেন পেট্রোল পাম্পের কাজে। পাহাড়-চা বাগান ঘেরা ডুয়ার্সে যা কার্যত নজিরবিহীন।

সব্যসাচী ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৪ ০১:১৯
পাম্পে কালিস্তা।

পাম্পে কালিস্তা।

দু’জনেই পড়তে চান। দু’জনেরই বাধা পরিবারের অবস্থা। ডুয়ার্সের মালবাজারের ডামডিম চা বাগানের দুই কিশোরী প্রিয়া ও কালিস্তার মধ্যে ছোটবেলা থেকেই বন্ধুত্ব। দারিদ্রকে হারিয়ে পড়ার তাগিদে জোট বেঁধেছেন দুই বান্ধবী। যোগ দিয়েছেন পেট্রোল পাম্পের কাজে। পাহাড়-চা বাগান ঘেরা ডুয়ার্সে যা কার্যত নজিরবিহীন।

মালবাজারের একটি স্কুলে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়েন কালিস্তা। প্রিয়া মালবাজার পরিমল মিত্র স্মৃতি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। দু’জনেরই গুডহোপ চা বাগানের ক্যারম লাইনের পাশাপাশি বাড়ি। ছোটবেলা থেকেই ভাল বন্ধুত্ব তাঁদের। পড়তে চাওয়ার জেদ থেকেই সমস্যার শুরু দু’জনের। তাদের বাড়ির আর্থিক অবস্থার জেরে পড়াশোনা মাঝপথেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয় দুই বান্ধবীর। কিন্তু তাতেও হার মানেনি তাঁদের জেদ।

এক দিন কলেজ যাবার সময় বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রিয়া। সেখানেই তাঁর কানে আসে ডামডিমের চাকলাবস্তির একটি পেট্রোল পাম্পে কর্মচারী খোঁজা হচ্ছে। বেতন মাসে আড়াই হাজার টাকা। কলিস্তার সঙ্গে দেখা হতেই সেই কথা বলেন তিনি। তার পরে দু’জনে মিলে সটান হাজির হন ৩১সি জাতীয় সড়ক লাগোয়া ওই পেট্রোল পাম্পটিতে। তাঁদের উৎসাহ দেখে অনেক বুঝিয়েও ওই দুই তরুণীকে ফেরাননি ম্যানেজার দুর্গাপ্রসাদ সিংহ। তাঁর কথায়, “ওঁদের লড়াকু মানসিকতা আমায় মুগ্ধ করে। বড় শহরে মেয়েরা পেট্রোল পাম্পে কাজ করলেও ডুয়ার্সে এই প্রথম মেয়েরা এই কাজে এসেছেন। ওঁরা যাতে ঠিকঠাক বাড়ি ফিরতে পারেন তাই সন্ধ্যার আগে ছুটি দেওয়া হচ্ছে।”

গুডহোপ বাগানের করন লাইনের বাড়িতে কালিস্তার মা স্যালভিয়া ও বাবা শুক্রা ওঁরাও থাকেন। দু’জনেই বাগানের শ্রমিক। সামনেই কালিস্তার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। তাঁর কথায়, “অনেকগুলো বই কেনার দরকার থাকলেও টাকার অভাবে কিনতে পারছিলাম না। গৃহশিক্ষক থাকলেও ভাল হত। কিন্তু সেই সামর্থ্য আমাদের নেই। পেট্রোল পাম্পের কাজটার কথা বাড়িতে বললে মা এক কথায় রাজি হন।” কালিস্তার মা স্যালভিয়াদেবী বলেন, “নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা তো করতেই হবে। আমাদের উপার্জনে ওর পড়ার খরচ চলে না। তাই স্বনির্ভর হতে পাম্পের কাজ বেছে নিয়েছে।”

প্রিয়ারও কলেজের পরীক্ষা আর মাস দু’য়েক পরে। মালবাজার পরিমল মিত্র স্মৃতি কলেজের প্রথম বর্ষে পাস কোর্সের ছাত্রী প্রিয়া পড়ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস ও দর্শন নিয়ে। বই কেনার টাকা ছিল না তাঁরও। তাঁর বাবা খেমা লোহার বছর সাতেক আগে মারা গিয়েছেন। বাড়িতে চা শ্রমিক মা লালকি লোহার ছাড়াও রয়েছেন দুই দাদা শ্যামলাল ও মধুরস। রয়েছে দুই বোন কুলফি ও খুসমনি। কুলফি এখন নবম শ্রেণিতে পড়ছে। খুশমনি অষ্টম শ্রেণি পাস করে পড়া ছেড়ে দিয়েছে। দাদারা তেমন কিছু করে না। “পড়া চালানোর পাশাপাশি সংসারে যতটা পারি টাকা দেব। সে জন্যই কাজটা করতে চেয়েছিলাম”, বললেন প্রিয়া। তাঁর মা লালকি জানালেন, “আমাদের বংশে ওই প্রথম স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ঢুকেছে। তাই পড়া চালাবার জন্যে পাম্পের কাজ করতে চাইলে আপত্তি করিনি। তা ছাড়া পাম্পটাও বাড়ি থেকে বেশি দূরে না হওয়ায় সুবিধাই হয়েছে।” সপ্তাহে ছ’দিনই কাজ করতে হয় প্রিয়া ও কালিস্তাকে। তাই নিয়মিত স্কুল-কলেজে তাঁরা যেতে পারেন না। তবে রবিবারে ছুটি না নিয়ে তাঁরা কাজের দিনে পাম্প থেকে ছুটি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস করেন। পরীক্ষা থাকলে তাঁদের পাম্প থেকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয় বলে জানান দুর্গাপ্রসাদবাবু।

ডুয়ার্সের চা বাগান এলাকায় ভিন রাজ্যের কাজে যোগ দেবার নাম করে পাচার চক্র সক্রিয় বলে অভিযোগ। সেই এলাকায় দুই আদিবাসী যুবতীর এই লড়াই প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়াবার বার্তা দেবে বলেই মনে করছেন সমাজকর্মীরা। ডুয়ার্সের নারী পাচার বিরোধী এক সংগঠনের তরফে রাজু নেপালি বললেন, “ডুয়ার্সের আদিবাসী মেয়েদের কাছে ইতিহাস হয়ে থাকবে। এই নজিরকে সকলের সামনে তুলে ধরতে পারলে আদিবাসী মেয়েরা দৃঢ় হবে।” মালবাজারের মহকুমাশাসক জ্যোতির্ময় তাঁতি বলেন, “দুই তরুণীর এই লড়াই আদিবাসী নয়া প্রজন্মকেই উদ্দীপ্ত করবে। ওদের জন্যে সকলের গর্ব হওয়া উচিত।”

ওই দুই তরুণী অবশ্য বলছেন তাঁদের মতো যে কেউই এই কাজ করতে পারবেন। কালিস্তা আর প্রিয়ার কথায়, “আমাদের এখানে মেয়েদের কাজ মানেই অবস্থাপন্ন বাড়িতে কাজ করা বা বাড়ির কাজ করা। এর বাইরেও যে আমরা অন্য কাজ করতে পারি তা আমরাও ভাবি না, আমাদের ভাবতেও দেওয়া হয় না। পেট্রোল পাম্পের কাজে যোগ দিয়ে বুঝতে পারছি এই কাজে এমন কোনও সমস্যা নেই যে মেয়েরা পারবে না। শুধু জড়তা কাটিয়ে এগিয়ে আসাটাই প্রয়োজন।”

international woman’s day sabyasachi ghosh malbajar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy