তিনশোরও বেশি মোটরবাইক নিয়ে মিছিল হচ্ছে শুনে আটকাতে গিয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনের ‘মডেল কোড অব কন্ডাক্ট’ (এমসিসি) রক্ষায় নিযুক্ত অফিসারেরা। উল্টে তাঁদেরই মারধরের অভিযোগ উঠল তৃণমূল নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে।
বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১০টা নাগাদ মালদহের মানিকচক থানার খয়েরতলা মোড়ের কাছে ঘটনাটি ঘটে। এমসিসি দলের দুই ওসি-সহ আট কর্মীকে মারধর করা হয়। ভেঙে দেওয়া হয় কমিশনের ক্যামেরা। অভিযুক্তদের অন্যতম রাজ্যের মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্রের জামাই টিঙ্কু ওরফে সোমদীপ সরকার। যাঁর সমর্থনে মিছিল বের করা হয়েছিল, দক্ষিণ মালদহ কেন্দ্রের সেই তৃণমূল প্রার্থী মোয়াজ্জেম হোসেনও ঘটনাস্থলে ছিলেন। যদিও মন্ত্রী ও প্রার্থীর দাবি, দলের কেউ কমিশনের কর্মীদের গায়ে হাত তোলেননি।
আগাম খবর দেওয়া সত্ত্বেও গোটা ঘটনায় পুলিশ কার্যত নিষ্ক্রিয় ছিল বলে এমসিসি-র সদস্যেরা অভিযোগ করেছেন। পরে অবশ্য পুলিশ কালু শেখ ও বিপিনবিহারী মণ্ডল নামে দুই তৃণমূল কর্মীকে গ্রেফতার করে। এর মধ্যে দ্বিতীয় জন মানিকচক পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য। মালদহের পুলিশ সুপার রূপেশ কুমার বলেন, “নির্বাচন কমিশনের কর্মীদের মারধরের অভিযোগে দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের খোঁজা হচ্ছে।”
হাবড়া ও হাওড়ার পরে ফের তাদের কর্মীরা আক্রান্ত হওয়ায় বিরক্ত নির্বাচন কমিশন। দিল্লিতে গণ্ডগোলের খবর পৌঁছনোর পরেই তড়িঘড়ি বৈঠকে বসেন কমিশনের শীর্ষকর্তারা। অভিযুক্তেরা যাতে দ্রুত গ্রেফতার হয়, তা দেখার জন্য মালদহের জেলাশাসক শরদ দ্বিবেদী এবং রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডিকে নির্দেশ দেয় নির্বাচন সদন। কী ব্যবস্থা নেওয়া হল, তা বিকেলের মধ্যে কমিশনকে জানাতেও বলা হয়।
উপ-নির্বাচন কমিশনার বিনোদ জুৎসি দিল্লিতে বলেন, “মানিকচকের ঘটনাকে আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছি। মোটরবাইক বাহিনীর নির্দিষ্ট অনুমতি না থাকায় কমিশনের কর্মীরা আপত্তি জানান। ফটো তোলারও চেষ্টা করেন। তখনই তাঁদের নিগ্রহ করা হয় বলে জানা গিয়েছে। পুলিশে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। প্রশাসনকে বলা হয়েছে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে।”
পাঁচ জেলার পুলিশ সুপারকে বদলির নির্দেশ দেওয়ায় দু’দিন আগেই নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ফেটে পড়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কমিশনকে সরাসরি চ্যালেঞ্জও করেন তিনি। এর পরেই এই ঘটনায় হাতে অস্ত্র পেয়ে গিয়েছেন বিরোধীরা। এ দিনই জলপাইগুড়ির হ্যামিল্টনগঞ্জে সাংবাদিক বৈঠক করেন অধীর চৌধুরী। তৃণমূল নেত্রীর নাম না করেও তাঁর কটাক্ষ, “উনি প্রকাশ্যে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে বদলা নেওয়ার কথা বলেছেন। এতে যে তৃণমূল কর্মীরা উৎসাহিত হয়ে এই ধরনের কাজ করবেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।’’
কংগ্রেসের দক্ষিণ মালদহের প্রার্থী আবু হাসেম খান চৌধুরী বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী যদি নির্বাচন কমিশনকে চ্যালেঞ্জ করে হুমকি দিতে পারেন, তাঁর দলের নেতা-কর্মীরা কমিশনের কর্মীদের গায়ে হাত তুলবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক।” সিপিএমের জেলা সম্পাদক অম্বর মিত্রের প্রশ্ন, “কমিশনের লোকেরাই যদি তৃণমূলের হাতে আক্রান্ত হয়, সাধারণ ভোটারদের নিরাপত্তা কোথায়?”
তৃণমূলের মুখপাত্র ডেরেক ও ব্রায়েন বলেন, “তৃণমূল দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল। আমরা নির্বাচন কমিশনকে সম্মান করি। তাদের নিয়ম-নির্দেশিকা মেনেই চলব। কিন্তু উত্তরবঙ্গে বহু জায়গাতেই মোটরবাইক যাতায়াতের এক মাত্র মাধ্যম। এক সঙ্গে ১০টির বেশি মোটরবাইক চলার ব্যাপারে কমিশনের নিষেধাজ্ঞাও সাংবাদিক থেকে পার্টিকর্মী অনেকে জানেন না। কেউ যাতে অজ্ঞানতাবশতও তা লঙ্ঘন না করেন, নির্বাচন কমিশনের সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করা উচিত। আমরাও করব।”
জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, মানিকচক ব্লকের এমসিসি সেল এবং ভিডিও সার্ভেইল্যান্স সেলে খবর এসেছিল, সকাল ১০টায় তৃণমূল তিন শতাধিক মোটরবাইক নিয়ে মথুরাপুর থেকে মিছিল বের করবে। এমসিসি সেলের ওসি দিলীপ সাহা এবং ভিডিও টিমের ওসি অজিত দাসের কথায়, “আমরা খয়েরতলায় গিয়ে দেখি, তিনশোরও বেশি মোটরবাইক নিয়ে তৃণমূল প্রার্থী মিছিল করছেন। আমরা তা বন্ধ করতে বলি।” তাঁদের অভিযোগ, “সে কথা শুনেই মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্রের জামাই ও তৃণমূলের একাধিক নেতা-কর্মী আমাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে চড়-ঘুষি মারতে থাকে। ধাক্কা দিয়ে মিছিলটি বেরিয়ে যায়। আমাদের গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়।”
এমসিসি দলের চিত্রগ্রাহক সমীরণ সাহা জানান, “নির্দেশ মতো আমি বাইক-মিছিলের ছবি তুলছিলাম।
তৃণমূল কর্মীরা ছুটে এসে ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে ভেঙে দেয়।” দলের আরেক কর্মী সিদ্ধার্থ মণ্ডল বলেন, “এক তৃণমূল কর্মী আমার বুকে ঘুষি মারে। ব্যথায় মাটিতে বসে পড়ি।” প্রহৃত কর্মী অফিসারদের অভিযোগ, আগাম জানানো সত্ত্বেও তাঁদের সঙ্গে পুলিশ দেওয়া হয়নি। তৃণমূল কর্মীরা মারধর করে মোটরবাইক মিছিল নিয়ে চলে যাওয়ার মিনিট পনেরো বাদে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। কিন্তু কাউকে ধরার চেষ্টাই করা হয়নি।
তৃণমূল প্রার্থী মোয়াজ্জেম হোসেন অবশ্য দাবি করেন, “আমাদের দলের কেউ কমিশনের লোকদের মারধর করেননি। দলের বদনাম করতে বহিরাগতেরা হামলা করেছে। আমি কমিশনের লোকদের বাঁচিয়েছি।” মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্রের দাবি, “জেলা প্রশাসন আপত্তি তোলায় আমরা মিছিল বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রার্থীকে নিয়ে দলীয় কর্মীরা গ্রামে ঢুকতে গেলে কমিশনের লোকেরা গাড়ি দিয়ে রাস্তা আটকে বাধা দেয়। আমাদের কর্মীরা প্রতিবাদ করেছিলেন, কিন্তু কমিশনের কারও গায়ে হাত তোলেননি। আমরাও পাল্টা অভিযোগ জানাব।”
এমসিসি কর্মীদের অভিযোগ পেয়ে মানিকচকের বিডিও সাংগে তাসি ডুগপা স্থানীয় থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। পুলিশ জানায়, সেই অভিযোগের ভিত্তিতে সোমদীপ সরকার, ব্লক তৃণমূল যুব সভাপতি মুকুলেশ্বর রহমান, স্থানীয় নেতা জামাল খান, মতিউর রহমানদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা করেছে। মালদহের জেলাশাসক শরদ কুমার দ্বিবেদী বলেন, “বিডিও-র রিপোর্ট রাজ্যের মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের কাছে পাঠানো হয়েছে।”
কলকাতায় মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের দফতরের মুখপাত্র অমিত রায়চৌধুরী জানান, মানিকচক থানায় কমিশনের কর্মীদের মারধর এবং বেআইনি মোটরবাইক ব্যবহারের দু’টি পৃথক এফআইআর দায়ের হয়েছে। জেলাশাসক ইতিমধ্যেই প্রাথমিক রিপোর্ট পাঠিয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে, তৃণমূল সমর্থকেরা নির্বাচন কমিশনের আর্থিক বিষয়ের পর্যবেক্ষক ও নির্বাচনী বিধি দেখভালের দায়িত্বে থাকা কর্মীদের উপরে হামলা করেছে। ওই ঘটনায় পুলিশ ছ’টি মোটরবাইক আটক করেছে। দ্রুত বিস্তারিত রিপোর্ট ও সিডি পাঠাতে বলা হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy