Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

মেয়ের পাকা দেখায় থাকলেন না স্বপন

রবিবার ছিল বড় মেয়ে রিনার পাকা দেখার দিন। গোটা সংসার আনন্দে মেতে থাকবে। ওইদিন কোতোয়ালি থানায় স্বামীর খুনের অভিযোগ জানাতে হল----কথা শেষ করতে পারলেন না বাসন্তীদেবী। প্রামাণিক পাড়ার বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন সদ্য বিধবা। জুয়ার আসর বসানোর প্রতিবাদ করতে গেলে গত শুক্রবার রাতে একদল দুষ্কৃতী তাঁর স্বামী স্বপন সরকারকে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করে।

নিহত স্বপনবাবুর শোকার্ত স্ত্রী বাসন্তীদেবী । ছবি: সন্দীপ পাল।

নিহত স্বপনবাবুর শোকার্ত স্ত্রী বাসন্তীদেবী । ছবি: সন্দীপ পাল।

নিজস্ব সংবাদদাতা
জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:৫১
Share: Save:

রবিবার ছিল বড় মেয়ে রিনার পাকা দেখার দিন। গোটা সংসার আনন্দে মেতে থাকবে। ওইদিন কোতোয়ালি থানায় স্বামীর খুনের অভিযোগ জানাতে হল----কথা শেষ করতে পারলেন না বাসন্তীদেবী। প্রামাণিক পাড়ার বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন সদ্য বিধবা। জুয়ার আসর বসানোর প্রতিবাদ করতে গেলে গত শুক্রবার রাতে একদল দুষ্কৃতী তাঁর স্বামী স্বপন সরকারকে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করে। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়ার পথে তিনি মারা যান।

শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে বাসন্তীদেবী জানান, স্বামী নিজে খোঁজ নিয়ে শিলিগুড়ি সংলগ্ন মেডিক্যাল মোড়ে বড় মেয়ের জন্য পাত্র দেখে আসেন। ঠিক হয় রবিবার পাত্রপক্ষ আসবে। পাকা কথা হবে। কী খাওয়াবেন তা নিয়ে শুক্রবার সকালে বাড়িতে কথা বলেন তিনি। ডুকরে কেঁদে চেয়ারে বসে পড়েন বাসন্তীদেবী। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, “ঘাতকরা সব শেষ করে দিল। এখন দুই মেয়ের কী হবে!” বৌমাকে সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে যেতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন স্বপনবাবুর মা রেণুবালাদেবী। ছেলের মৃত্যুর পর থেকেই তিনি অঝোরে কেঁদে চলেছেন। কেউ সামনে দাঁড়াতে বলছেন, “আমার ছেলেটা এখনও বাড়িতে এলো না কেন!”

স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে পেশায় মুরগি মাংস বিক্রেতা স্বপনবাবুর ছিল ভরা সংসার। পাকা বাড়ি তৈরির কাজ সবে শুরু করেছিলেন। বারান্দার এক পাশে পড়ে আছে মোটরবাইক। ছেলে কৃষ্ণ বলেন, “বাবা ওই মোটরবাইকেই হাটে যেতেন। শুক্রবার দুপুরেও নিয়ে যান। কিন্তু রাতে এলাকার একজন বাইক বাড়িতে দিয়ে যায়। বলে দাদাকে দেখছি না। ফাঁকা জায়গায় বাইক পড়ে আছে। দিয়ে গেলাম।” ছেলের কথা শুনে মায়ের হাহাকার, “আমি কি তখন জানতাম সিঁথির সিঁদুর ওঁরা কেড়ে নিয়েছে!”

স্বপনবাবুর দুই মেয়ে। বড় মেয়ে রিনা বোনাপাড়া হাইস্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী। ছোট মেয়ে সন্ধ্যা পড়ছে অষ্টম শ্রেণিতে। বাসন্তীদেবী জানান, খোলা মনের মানুষ ছিলেন স্বামী। মেয়েরা যা চাইত এনে দিতেন। বলতেন লেখাপড়া করে বড় হতে। মায়ের কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ে রিনা ও সন্ধ্যা।

সরকার পরিবারের আর্তনাদে বিষণ্ণতার ছায়া নামে প্রামানিক পাড়ায়। ঘোর কাটেনি প্রতিবেশীদের। এলাকায় ঝরু নামে বেশি পরিচিত ছিলেন নিহত ব্যবসায়ী। বরুণ দাস, মালতি রায়ের মতো পড়শিরা বাড়িতে এলেও সান্ত্বনা জানানোর ভাষা খুঁজে না পেয়ে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সকাল থেকে রাজনৈতিক দল সহ বহু মানুষ বাড়িতে ভিড় করছেন। সমবেদনা জানাতে উঠানে পেতে রাখা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে তাঁরা বলছেন অনেক কিছু। শুক্রবার রাত থেকে স্বপনবাবুর অশীতিপর দিদিমা প্রভাসিনী দেবীর চোখে ঘুম নেই। ভিড় দেখে তিনি বাড়ির সামনে মেঠো রাস্তায় চলে যান। শুকনো চোখে বলেন, “কোথায় আমার শ্মশান যাত্রা হবে, মুখাগ্নি করবে, সেই ঝরুটাই চলে গেল।”

এ দিন মৃত ব্যবসায়ীর বাড়িতে যান কংগ্রেসের জেলা সভাপতি নির্মল ঘোষ দস্তিদার এবং বিধায়ক সুখবিলাস বর্মা। নির্মলবাবু বলেন, “দুষ্কৃতীরা শাসক দলের প্রচ্ছন্ন মদত না পেয়ে থাকলে এত সাহস হতো না।” পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিধায়ক। তিনি বলেন, পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার কারণে রাজ্যের অন্য এলাকার মতো খারিজা বেরুবাড়ি এলাকা দুষ্কৃতীদের দখলে চলে গিয়েছে।”

কংগ্রেস বিধায়কের অভিযোগের সঙ্গে একমত বিজেপি যুব মোর্চার জেলা সভাপতি জয়ন্ত চক্রবর্তীও। সকালে সংগঠনের সমর্থক মৃত ব্যবসায়ীর পরিবারের সঙ্গে দেখা করে তিনি বলেন, একজোট হয়ে জুয়া মদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তাব রেখেছি। জেলা বিজেপি সভাপতি দীপেন প্রামানিক জানান, কেন অভিযুক্তরা এখনও অধরা জানতে আজ, মঙ্গলবার জেলাপুলিশ সুপারের সঙ্গে দলের প্রতিনিধিরা কথা বলবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE