ওয়টস্যাপে অবিশ্বাস আর যন্ত্রণায় ডুবে থাকার কথা লিখেছেন রুবিনা বশির। দিন কয়েক আগেই জনে জনে কলকাতায় তাঁর সহপাঠী, বন্ধু থেকে কলেজের অধ্যাপকদের ভূস্বর্গের বাড়িতে নেমন্তন্ন করছিলেন তিনি। কলকাতার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হোমিয়োপ্যাথির ডাক্তার রুবিনা বশির বুধবার সকালে ওয়টস্যাপে লেখেন, ‘‘বিশ্বাস করো, এ যন্ত্রণা আমার মতো প্রতিটি কাশ্মীরিরও! এই নিষ্ঠুর ঘৃণ্য কাজটি যারাই করে থাকুক, তারা আসলে কাশ্মীরের শত্রু!’’
নিউ মার্কেটের শতাব্দী-প্রাচীন কাশ্মীরি উপহার বিপণির কর্তা সাজ্জাদ হায়দার ফরিদও বলছেন, ‘‘এ আঘাত শুধু ইনসানিয়াতকে (মানবতা) নয়! কাশ্মীরিয়তও আক্রান্ত, যা বরাবর সবাইকে নিয়ে চলতে শেখায়।’’ এ দিন দুপুরেই বাডগামের শেখপুরায় তাঁর পরমাত্মীয় শওকত আহমেদ শেখের সঙ্গে কথা বলছিলেন সোদপুরের মেডিক্যাল রিপ্রেজ়েন্টেটিভ সঞ্জু পাল। বললেন, ‘‘শওকত ভাই, লুবনা ভাবিরা খুব খারাপ আছেন! যা ঘটেছে, তার জন্য ওঁরাও মরমে মরে আছেন!’’
দু’বছর আগে কাশ্মীরে বেড়াতে গিয়েই শওকতদের সঙ্গে বিনিসুতোর বাঁধন সঞ্জু, তাঁর স্ত্রী পিয়ালি, কন্যা সৃঞ্জিনীর। সেও এক মারাত্মক দুর্ঘটনার সূত্রে। সঞ্জুদের সফরসঙ্গী এক বন্ধু শ্রীনগরের কাছে পথ দুর্ঘটনায় মারাও যান। আর পা ভেঙে তিন মাসের জন্য শয্যাবন্দি হয়ে পড়েন পিয়ালি। সরকারি ঠিকাদার শওকতদের সঙ্গে হাসপাতালেই আলাপ সঞ্জু, পিয়ালিদের। শওকতের ভাইও তখন সেই হাসপাতালে ভর্তি। পিয়ালিকে নিয়ে সেই বিভুঁয়ে তিন মাস কোথায় থাকবেন, কী করবেন ভেবে পরিবারটি যখন দিশেহারা, শওকত-লুবনারাই তিন মাসের জন্য তাঁদের পরিবারে ওঁদের আপন করে নিয়েছিলেন।
সঞ্জু, পিয়ালিরা এখন বলে থাকেন, আমাদের দুটো বাড়ি— একটা সোদপুরে, অন্যটা কাশ্মীরে! দুর্ঘটনার বিভীষিকার স্মৃতি ঝেড়ে ফেলে দিন দশেক আগেই উপত্যকায় শওকত ভাইয়ের বাড়ি ঘুরেও এসেছেন। সঞ্জু বলছিলেন, ‘‘আমরা শুধু যে অনেক অজানা জায়গায় ঘুরেছি, তা-ই নয়, আপনজনের সঙ্গে সময় কাটাতেই গিয়েছিলাম। খুব কষ্ট হচ্ছে, কিছু অমানুষের নৃশংসতায় এই ভালবাসার কাশ্মীরের ভাবমূর্তি খারাপ হচ্ছে। কাশ্মীরকে যারা ভালবাসে, সবার জন্য এটা যন্ত্রণার।’’
পহেলগামের বীভৎস ঘটনার নিন্দা করে শোকার্ত কাশ্মীরি নরনারীর পথে নামার ছবি ছড়িয়ে পড়েছে। নিউ মার্কেটের দোকানে সাজ্জাদ, পুরনো কর্মচারী সাদিক বাটেরা বলছিলেন, কাশ্মীরে বহু পরিবার আতঙ্কগ্রস্ত পর্যটকদের নিজের বাড়িতেও আশ্রয় দিয়েছেন। আবার ভয়ানক হামলার জেরে সমাজমাধ্যমের প্রতিক্রিয়া এ রাজ্যেও অনেকের ভিতরের সুপ্ত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে টেনে বের করে আনছে। কলকাতার এক কলেজ শিক্ষিকা, আদতে কাশ্মীর কন্যা নওশিন বাবা খান বলছিলেন, ‘‘যা ঘটেছে, তার প্রতিবাদ তো সবারই করা উচিত। এক ধরনের ধর্মীয় মৌলবাদ, ইসলামের অপব্যাখ্যা করে নৃশংসতা, প্রাণহানির পক্ষে সওয়াল করে। আমিও তার প্রতিবাদ করছি। আবার সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটলেই সব মুসলিমকে এক গোত্রে ফেলে ভয়ানক স্টিরিয়োটাইপ তৈরির চেষ্টাও ক্লান্তিকর।’’ নওশিনের তুতো ভাই, বোন, কাকা, পিসিরা কাশ্মীরে। তাঁদের সঙ্গে তিনি ঘন ঘন কথা বলছেন। রুবিনা বলছিলেন, ‘‘পর্যটন হল কাশ্মীরের প্রাণভোমরা। যা ঘটেছে, তাতে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষকেও ভুগতে হবে। কলকাতার আপনজনদের এত বার বাড়িতে ডাকলেও, এখন কী-ই বলব, ভেবে পাচ্ছি না।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)