Advertisement
E-Paper

মুক্তি চেয়ে মরিয়া ভাঙড়, শুধু গ্রিড নয়, আরাবুলের জমি দখলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ

গামছায় বারবার চোখের জল মুছছিলেন শেখ সামসুদ্দিন।‘‘বাপ-ঠাকুরদার জমি চাষ করে খাচ্ছিলাম। ওরাই তো পেটে লাথি মারল। জমি কেড়ে নিল। এখন জনমজুরের কাজ করে পেট চালাচ্ছি।’’ বলতে বলতে উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছিলেন সামসুদ্দিন (নাম পরিবর্তিত)।

শুভাশিস ঘটক

শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:২৫
আরাবুলের বিরুদ্ধে জনরোষ। সামসুল হুদার তোলা ছবি।

আরাবুলের বিরুদ্ধে জনরোষ। সামসুল হুদার তোলা ছবি।

গামছায় বারবার চোখের জল মুছছিলেন শেখ সামসুদ্দিন।

‘‘বাপ-ঠাকুরদার জমি চাষ করে খাচ্ছিলাম। ওরাই তো পেটে লাথি মারল। জমি কেড়ে নিল। এখন জনমজুরের কাজ করে পেট চালাচ্ছি।’’ বলতে বলতে উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছিলেন সামসুদ্দিন (নাম পরিবর্তিত)। তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন জনা দশেক গ্রামবাসী। ক্ষোভ তাঁদেরও কিছু কম নয়!

কাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ?

সমস্বরে উত্তর: আরাবুল ইসলাম আর ওঁর দলবল।

শুক্রবারের দুপুর। ঘটনাস্থল ভাঙড়ের উড়িয়াপাড়া। তিন দিন আগের তাণ্ডবের জেরে এখনও থমথমে। রাস্তার ধারে বসে সামসুদ্দিনের হাহাকার তাই আরও বেশি করে বাজছিল।

কে এই সামসুদ্দিন? মাসতিনেক আগেও ছিলেন জমিহারা সাধারণ গ্রামবাসী। এখন ‘জমি-জীবিকা-বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ রক্ষা কমিটি’র সদস্য। তাঁকে ঘিরে থাকা গ্রামবাসীরাও তাই। তাঁদের বক্তব্য, শুধু পাওয়ার গ্রিডের বিরুদ্ধেই আন্দোলনে নামেননি তাঁরা। তাঁদের ক্ষোভের কারণ আরও গভীরে। সেই কারণ জানতে গিয়েই অন্তর্তদন্তে উঠে এসেছে কৃষিজীবীদের জমি হারানোর করুণ কাহিনি। যে কাহিনি জুড়ে রয়েছে আরাবুল ও তাঁর বাহিনীর দীর্ঘ কয়েক বছরের ‘অত্যাচার’ আর তাকেই হাতিয়ার করে নকশাল নেতাদের একাংশের ঢুকে পড়া। আরাবুলের বিরুদ্ধে তলে তলে গ্রামবাসীদের সংগঠিত করেছেন ওই নেতারাই।

সামসুদ্দিনরা দাবি করেছেন, মঙ্গলবারের আন্দোলনে যে সব গ্রামবাসী ছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই পাওয়ার গ্রিডের সাব-স্টেশন তৈরির বিরোধী নন। কেননা, সে জন্য মাত্র ১৩ একর জমি নেওয়া হয়েছে। তা-ও বছর চারেক আগে। তাঁদের বিরোধিতা— যে কায়দায় বহু কৃষিজমি দখল করে নিয়েছে আরাবুল বাহিনী, তার বিরুদ্ধে। এর মধ্যে এলাকায় আরও কয়েকটি আবাসন প্রকল্প তৈরি হচ্ছে। এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, এর জন্য ১৫০০ বিঘা জমি প্রয়োজন। সেই জমি দখলের জন্য বরাত দেওয়া হয়েছে আরাবুল বাহিনীকেই। যে কায়দায় এত দিন ধরে আরাবুলরা জমি দখল করে এসেছেন, এ বারেও সেই কৌশলই কাজ করবে বলেই কৃষিজীবীদের আশঙ্কা— আবার বোধহয় সর্বস্বান্ত হতে হবে তাঁদের।

কী সেই কায়দা?

গ্রামবাসীদের অভিযোগ, মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে কাগজে সই করিয়ে বিঘের পর বিঘে জমি কেড়েছে আরাবুল বাহিনী। ২০০৯-১০ সালে কাঠা প্রতি যে জমির দাম ছিল ৫০-৬০ হাজার টাকা, তা আরাবুলরা কিনেছেন ১০-২০ হাজারে। কখনও বা বিনা পয়সায়। আর সেই জমি প্রোমোটারদের বেচেছেন দ্বিগুণেরও বেশি দামে। কোনও কোনও জমির কাগজ জাল করেও বিক্রি করা হয়েছে। আরাবুল ঘনিষ্ঠ এক জমির কারবারিও বলছেন, ‘‘প্রতিবাদ করার কোনও জায়গাই রাখেননি আরাবুল। ইচ্ছেমতো দামে জমি কিনেছেন। বেচেছেন।’’

তা হলে কেন কৃষকেরা এত দিন থানা-পুলিশ বা প্রশাসনের দ্বারস্থ হননি?

এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘প্রথমে ভেবেছিলাম, থানায় সুরাহা মিলবে। কিন্তু থানায় গেলেই দেখি, সেখানে আরাবুল বা দলের কেউ বসে রয়েছেন। তাঁরা আমাদের অভিযোগপত্র ছিঁড়ে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন। ভূমি দফতরে গিয়েও একই ব্যবহার পেয়েছি।’’

পাওয়ার গ্রিডের সাব-স্টেশনের জমি কেনাবেচার সময়েও আরাবুল বাহিনী চুপ করে থাকেনি। ভুক্তভোগী একাধিক চাষির কথায়, ‘‘সরকারি নিয়ম মতো যাঁর জমিতে পাওয়ার গ্রিডের টাওয়ার বসবে, সেই জমির মালিক টাওয়ার প্রতি আড়াই লক্ষ টাকা পাবেন। কিন্তু জাল কাগজ দাখিল করে বহু চাষির টাকা আত্মসাৎ করেছেন আরাবুলরা।’’

কী করে এত ‘ক্ষমতাবান’ হয়ে উঠলেন আরাবুল?

এলাকার বাসিন্দাদের বক্তব্য, ২০০৬ সালে তৃণমূলের টিকিটে জিতে প্রথম বার বিধায়ক হন আরাবুল। তখন থেকেই ভাঙড়ে তাঁর ‘রাজত্ব’ শুরু। দ্রুত নগরায়ণের জন্য রাজারহাট, নিউটাউন, হাড়োয়া ঘেঁষা দক্ষিণ ২৪ পরগনার এই এলাকায় জমির দাম হু হু করে বাড়ছিল। সেই সুযোগে আরাবুল ও তার দলবল আদাজল খেয়ে নেমে পড়েন। গোয়েন্দাদের কাছেও খবর, গত ক’বছরে চাষিদের থেকে প্রায় ৫০০ বিঘা জমি দখল করেছিলেন আরাবুলরা। আরাবুল নিজে অবশ্য এ সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর দাবি, ‘‘সব মিথ্যা কথা।’’

ঘটনা হল, ২০১১-র নির্বাচনে পরিবর্তনের প্রবল হাওয়াতেও হেরেছিলেন আরাবুল। কিন্তু এলাকাবাসীর অভিজ্ঞতা বলছে, নিজে হারলেও পালাবদলের পরে আরাবুল পুরোপুরি ‘বেলাগাম’ হয়ে যান। ভাঙড় কলেজের শিক্ষিকা-নিগ্রহ থেকে ২০১২ সালে তৎকালীন বাম বিধায়ক রেজ্জাক মোল্লাকে মারধরের অভিযোগ— আরাবুল বারবার শিরোনামে। তবু তাঁর সমর্থনেই ভাঙড়ে এসে মিছিল করে যান তৃণমূলের প্রথম সারির নেতারা। আরাবুলকে ‘তাজা নেতা’ বলে প্রশংসা করেন। পরে জনমতের চাপে আরাবুল গ্রেফতার হলেও কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি জামিন পান। দল তাঁকে ছ’মাসের জন্য সাসপেন্ড করেছিল। কিন্তু ২০১৬র নির্বাচনের আগে ‘সাসপেনশনের’ মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাঁকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘তৃণমূল নেতারা বারবারই বুঝিয়ে দিয়েছেন, আরাবুলের বিরুদ্ধে কিছু করা যাবে না। কয়েক জন গ্রামবাসী শীর্ষনেতাদের জানিয়েছিলেন। উল্টে তাঁদেরই ধমক খেতে হয়েছে আরাবুলের কাছে।’’

এহেন আরাবুলকে অবশ্য ধাক্কা খেতে হয়েছিল গত বছর বিধানসভা ভোটেই। সিপিএম থেকে তৃণমূলে আসার ‘পুরস্কার’ হিসেবে রেজ্জাক মোল্লাকে ভাঙড়ের টিকিট দেয় তৃণমূল। আরাবুলের আপত্তি ধোপে টেঁকেনি। বরং তাঁকেই রেজ্জাকের নির্বাচনী এজেন্ট করে জুড়ে দেয় দল। রেজ্জাক জেতেন। এবং অভিযোগ করেন, আরাবুল তাঁকে হারানোর চেষ্টা করে গিয়েছেন। তৃণমূলের একাংশের বক্তব্য, মন্ত্রিসভার সদস্য হয়ে ‘বদলা’ নিতে শুরু করেন রেজ্জাক। শুরু হয় আরাবুলকে কোণঠাসা করার কাজ। রেজ্জাকের হাত ধরে ভাঙড়ের বহু সিপিএম কর্মী-সমর্থক ধীরে ধীরে তৃণমূলে চলে আসেন। ধুরন্ধর রাজনীতিক রেজ্জাকের সঙ্গে যুঝতে পারেননি আরাবুল।

তৃণমূলের একটি সূত্রের দাবি, পাওয়ার গ্রিডের মতো একটি সরকারি কাজ রেজ্জাকের লোকজন ‘আটকে’ দিয়েছেন বলে প্রমাণ করতে চাইছিলেন আরাবুল। তাই নকশালদের কয়েক জন নেতার এলাকায় আসা-যাওয়ার কথা জানা থাকলেও বিশেষ উচ্চবাচ্য করেননি তিনি। দলের একাংশের বক্তব্য, আরাবুলের আসলে ধারণা ছিল, পাওয়ার গ্রিডের আন্দোলনের ফলে দলের সর্বোচ্চ স্তরে হেয় হবেন রেজ্জাক। তখন পরিস্থিতি বুঝে পাওয়ার গ্রিডের আন্দোলন তুলে নেবেন আরাবুল। তাতে দলে নিজের দরও যেমন বাড়বে, ফের ক্ষমতাশালী হয়ে জমি ‘দখল’-এর কাজও সহজে করতে পারবেন।

কিন্তু তাঁরই ‘হাত ধরে’ এলাকায় ঢুকে নকশালরা যে তাঁর বিরুদ্ধেই মানুষের ক্ষোভকে অস্ত্র করবে, তা আন্দাজ করতে পারেননি আরাবুলও। পাওয়ার গ্রিডের আন্দোলন রাতারাতি তাই রূপ নিয়েছে কৃষিজমি ফিরে পাওয়া এবং আরাবুল বাহিনীর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার আন্দোলনে। ভাঙড়-২ এলাকার পোলেরহাট ২ পঞ্চায়েতের খামারআইট, উড়িয়াপাড়া, টোনা— সব এলাকার কৃষিজীবী তাতে সামিল হয়েছেন। এই পোলেরহাট-২ পঞ্চায়েতই এখন এই আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি।

তৃণমূলের এক নেতা বলেন, ‘‘লড়াই এখানে পাওয়ার গ্রিডের সাব-স্টেশন নিয়ে নয়। ‘পাওয়ার’ (রাজনৈতিক ক্ষমতা) এবং ‘গ্রিড’ (সীমাহীন লোভ)-এর বিরুদ্ধেই এককাট্টা হয়েছেন মানুষ।’’

Bhangar Unrest Arabul Islam
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy