Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
দোষারোপ কিছু ছাত্রনেতা-শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীকে

টাকার খেলায় অনলাইনের পিঠে ছুরি: পার্থ

দুর্নীতির মূলোচ্ছেদের সম্ভাবনা যে-পথে সব চেয়ে বেশি, সেই কেন্দ্রীয় অনলাইন ব্যবস্থায় কলেজে ছাত্র ভর্তি চাননি তিনি। তবে বলেছিলেন, ভর্তিতে কলেজ-ভিত্তিক অনলাইন ব্যবস্থা চলবে। এখন সেই শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ই অভিযোগ তুললেন, অনলাইন ব্যবস্থাকে পিছন থেকে ছুরি মারা হচ্ছে। টাকা নিয়ে ছাত্রছাত্রী ভর্তির চক্র আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় ও মধুরিমা দত্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৫ ০৩:৪০
Share: Save:

দুর্নীতির মূলোচ্ছেদের সম্ভাবনা যে-পথে সব চেয়ে বেশি, সেই কেন্দ্রীয় অনলাইন ব্যবস্থায় কলেজে ছাত্র ভর্তি চাননি তিনি। তবে বলেছিলেন, ভর্তিতে কলেজ-ভিত্তিক অনলাইন ব্যবস্থা চলবে। এখন সেই শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ই অভিযোগ তুললেন, অনলাইন ব্যবস্থাকে পিছন থেকে ছুরি মারা হচ্ছে। টাকা নিয়ে ছাত্রছাত্রী ভর্তির চক্র আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

শুধু অভিযোগেই থেমে থাকেননি মন্ত্রী। কারা কলেজে ভর্তির এই সরল প্রক্রিয়া ভন্ডুল করার চেষ্টা করছেন, তা যে তিনি বিলক্ষণ জানেন, বৃহস্পতিবার শিক্ষা দফতরের বড়, মেজো, ছোট কর্তাদের সামনে বলে ফেললেন সেটাও। তাঁর কাছে এ ব্যাপারে অনেক অভিযোগ এসেছে। তিনি নিজেও খোঁজখবর নিয়েছেন। এ দিন টাউন হলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার কৃতীদের সম্মাননা অনুষ্ঠানের শেষে শিক্ষা দফতরের কর্তাদের সামনে পেয়ে তাই রাগের লাভা উগরে দেন শিক্ষামন্ত্রী।

গলা তুলে শিক্ষা দফতরের কর্তাদের উদ্দেশে পার্থবাবুকে বলতে শোনা যায়, ‘‘নিজে শিক্ষামন্ত্রী হয়েও বলছি, অনলাইন ভর্তি প্রক্রিয়া ‘টোটাল ফেলিওর’ (পুরোপুরি ব্যর্থ)। বেশির ভাগ কলেজ এটা করছে না। ছাত্রছাত্রীরাও অনেকে করাতে চাইছে না।’’ অনলাইন প্রক্রিয়া ভন্ডুল করার জন্য এক শ্রেণির শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী
ও ছাত্রনেতা কী ভাবে উদ্যোগী হয়েছেন, তা-ও জানান শিক্ষামন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘কলেজের সামনে-পিছনে ত্রিপল টাঙিয়ে ওরা সব ১০০ টাকা করে ফর্ম বিক্রি করছে! সব খবর আছে। কয়েক বার ধরার চেষ্টা করেছি, পালিয়ে গিয়েছে। কলেজগুলিকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি। এ বার কিন্তু কোমর বেঁধে নামছি।’’

শিক্ষামন্ত্রীর মুখে এ-হেন হুমকি শুনে উপস্থিত আমলারা থ। উত্তেজিত পার্থবাবুকে তখন কোনও মতেই থামানো যাচ্ছে না। তিনি বলতে থাকেন, ‘‘কলেজগুলোর অনেকেই অনলাইনে ছাত্র ভর্তি করতে উৎসাহ দেখাচ্ছে না।’’ কেন? এক, দুই, তিন করে মন্ত্রীর বিশ্লেষণ, ‘‘প্রথমত, নতুন এই ব্যবস্থায় কলেজগুলির খাটাখাটনি বাড়ছে। ওরা বাড়তি খাটতে চাইছে না। দ্বিতীয়ত, প্রসপেক্টাস-ফর্ম ইত্যাদি বিক্রি করে কলেজের যে-আয় হত, সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তৃতীয়ত, অনলাইনে ভর্তি না-করার জন্য ছাত্র সংসদগুলি অধ্যক্ষদের উপরে চাপ সৃষ্টি করছে। আমি সব জানি।’’

রাজ্যের বেশির ভাগ কলেজেই এখন শাসক দল প্রভাবিত ছাত্র ইউনিয়ন। তা সত্ত্বেও মন্ত্রী নিজের অভিযোগ থেকে সরতে নারাজ। ছাত্র সংগঠনগুলির স্বার্থ কী?

পার্থবাবু বলেন, ‘‘আসলে ছাত্র সংসদগুলি কম নম্বর পাওয়া পরীক্ষার্থীদের কলেজে ঢোকাতে পারছে না। টাকার খেলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাই ছাত্র সংসদ কোথাও কোথাও অধ্যক্ষদের উপরে চাপ দিয়ে অনলাইন প্রক্রিয়ায় কিছু গোলমাল করিয়ে রাখতে চাইছে। এর ফলে ছাত্রছাত্রীরা ছাত্র সংসদের শরণাপন্ন হচ্ছেন। টাকা দিয়ে ভর্তির চক্র ফের সক্রিয় হয়ে উঠছে।’’

ভর্তিতে টাকার খেলা চলে বলে বিভিন্ন শিবির থেকে অভিযোগ ওঠায় কেন্দ্রীয় ভাবে অনলাইন চালু করার কথা উঠেছিল ব্রাত্য বসু শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালেই। কিন্তু শিক্ষার দায়িত্ব পেয়ে পার্থবাবু কেন্দ্রীয় অনলাইন হবে না বলে জানিয়ে দেন। এখন তিনিই ভর্তিতে টাকার খেলার প্রত্যাবর্তনের অভিযোগ তুলছেন। এটা কতটা আত্মসমালোচনা আর কতটাই বা নিজের অসহায়তার প্রকাশ, তার জবাব মিলছে না। তবে মন্ত্রী জানান, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তিনি নিজে ছাত্র সংসদের নেতাদের ডেকে অফলাইনে ছাত্র ভর্তি থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

পার্থবাবু এ দিন মন্তব্য করেন, ‘‘হতে পারে, আমরা বারণ করায় ছাত্র সংসদগুলি সরাসরি কিছু করতে পারছে না। এখন তারা পরোক্ষে অধ্যক্ষদের উপরে চাপ তৈরি করছে। নামী কলেজগুলোয় এটা বেশি হচ্ছে। আমি ছাত্র ও অভিভাবকদের একটা অংশকেও এর জন্য দায়ী করব। কারণ, ইন্টারনেটের এই রমরমার যুগে তাঁরা এখনও অনলাইন আবেদনে স্বচ্ছন্দ হতে পারছেন না।’’

খোদ শিক্ষামন্ত্রীর অভিযোগ নিয়ে শিক্ষাকর্তারা টুঁ শব্দটিও করেননি। তাঁদের এক জন বলেন, ‘‘মন্ত্রী কলেজের, অধ্যক্ষ আর ছাত্র সংসদের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। ওদেরই জিজ্ঞাসা করুন।’’

শিক্ষামন্ত্রীর অভিযোগের ব্যাপারে কী বলছেন কলেজের অধ্যক্ষেরা?

বর্ধমান রাজ কলেজের টিচার-ইনচার্জ তারকেশ্বর মণ্ডল বলেন, ‘‘এটা ঠিক যে, আগে ফর্ম-প্রসপেক্টাস বিক্রি থেকে ১০-১২ লক্ষ টাকা আয় হত কলেজের। এখন সেটা অনেক কমে গিয়েছে। আমাদের ৫০ শতাংশ টিউশন ফি সরকারকে দিয়ে দিতে হয়। তাই কলেজের আর্থিক ক্ষতি তো হচ্ছেই। তবে সরকার যখন বলেছে, আমরা অনলাইন করতে বাধ্য।’’ তাঁর মন্তব্য, কী ভাবে অনলাইনে ফর্ম ভর্তি করতে হয়, ছাত্র সংসদের প্রতিনিধি এবং শিক্ষকদের অনেকেই সেই নিয়ম জানেন না। তাই তাঁরা কলেজে ভিড় করা ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য করতে পারছেন না। ‘‘পার্থবাবু ঠিকই বলেছেন,’’ বললেন ওই অধ্যক্ষ।

পার্থবাবু যে খুব একটা ভুল বলেননি, তা জানিয়ে দেন বহরমপুর কলেজের অধ্যক্ষ সমরেশ মণ্ডলও। তিনি বলেন, ‘‘অনেক ক্ষেত্রেই ছাত্র ইউনিয়ন এবং কলেজ-কর্তৃপক্ষের একটা অশুভ আঁতাঁত কাজ করে। তবে সরকারকে সাধুবাদ জানাচ্ছি, এই অনলাইন ব্যবস্থা চালু করার জন্য।’’ আর কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষা জয়শ্রী রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘আমরা একেবারেই চাই না, অফলাইনে ভর্তি হোক। অনলাইনে ভর্তির ব্যাপারে ছাত্র ইউনিয়নগুলোও আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করছে।’’

কী বলছে ছাত্র সংগঠনগুলি?

তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সম্পাদক তমোঘ্ন ঘোষ বলেছেন, ‘‘দলগত ভাবে কোনও মন্তব্য করতে পারব না। তবে এটুকু বলছি যে, আমরা অনলাইন ব্যবস্থার পক্ষে।’’

কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী তো ছাত্র সংসদগুলিকেও দায়ী করছেন। সেই অভিযোগের ব্যাপারে কী বলবেন?

তমোঘ্ন বলেন, ‘‘পার্থবাবুর মন্তব্যের বিরোধিতা করতে পারছি না।’’ এসএফআইয়ের রাজ্য সভাপতি মধুজা সেনরায় বলেন, ‘‘শিক্ষামন্ত্রী তাঁর দলের ইউনিয়নের কথাই বোধ হয় বলতে চাইছেন। কারণ, বেশির ভাগ কলেজে ওঁদেরই ছাত্র সংসদ। পার্থবাবুর অসহায় অবস্থাটা বুঝতে পারছি।’’ ছাত্র পরিষদের রাজ্য সম্পাদক কৌস্তুভ বাগচীর বক্তব্য, পার্থবাবু যে নিজের দলের ছাত্র সংসদকেই নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ, সেটা তাঁর কথাতেই পরিষ্কার। ‘‘উনি যদি প্রমাণ করতে পারেন যে, বিরোধী ছাত্র সংসদগুলি কোথাও অনলাইন ভর্তি ব্যবস্থার বিরোধিতা করছে, তা হলে আমি রাজনীতি করাই ছেড়ে দেব,’’ বলেছেন কৌস্তুভ।

বিরোধী দলের ছাত্রনেতাদের অভিযোগ, ভর্তির সময় তৃণমূল ছাত্র পরিষদের এই ‘মরসুমি ব্যবসা’ দীর্ঘদিনের। অনলাইন ভর্তি ব্যবস্থায় সেটা মার খাচ্ছে। ওরাই সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ভাবে অনলাইনে ভর্তি শুরু হলে এই সব সমস্যা হতই না বলে মনে করেন বিরোধী শিবিরের ছাত্রনেতারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE