বিধানসভায় শাসক-বিরোধীর অশান্তি নতুন কিছু নয়। তবে এ বার বিরোধী পক্ষের সব বক্তব্য বিধানসভার নথি থেকে বাদ দিয়েই পাশ হল বিক্রয়কর সংশোধনী সংক্রান্ত বিল। ঘটনাটিকে নজিরবিহীন বলে মেনে নিলেও কোনও পক্ষই এই ‘বিচ্যুতি’র দায় নিতে রাজি হয়নি।
বকেয়া বিক্রয়কর মিটিয়ে নিতে কর-খেলাপিদের জন্য নতুন করে আইনি ব্যবস্থা চালু করতে বুধবার সংশোধনী বিলটি পেশ করেছিলেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। আলোচনার দ্বিতীয় পর্বে বৃহস্পতিবার শাসক ও বিরোধী পক্ষের বক্তারা বিল নিয়ে আলোচনায় নিজেদের রাজনৈতিক লাইন বজায় রেখে বক্তৃতাও করেছেন পরপর। বিরোধী শিবিরের শেষ বক্তা, বালুরঘাটের বিজেপি বিধায়ক অশোক লাহিড়ী সংশোধনী পাশ করতে তাড়াহুড়ো নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, ‘‘শাস্তি, সুদ ছেড়ে দিয়ে করে ছাড় দেওয়ার যে ব্যবস্থা সরকার চাইছে, তা খুব কার্যকর কিছু নয়। শাস্তির লাঠি দেখাতে হয়।’’ তাই সংশোধনীটি স্ট্যান্ডিং কমিটিতে পাঠানোর দাবি তোলেন তিনি। আগে আইন করে দেওয়া ছাড়ে কত টাকা উদ্ধার হয়েছে বা কত জনকে শাস্তি দেওয়া গিয়েছে, সে সব নিয়ে তথ্যও চান মন্ত্রীর কাছে।
গোল বাঁধে মন্ত্রী জবাব দিতে উঠলে। ওই সময়ে বিজেপি বিধায়কেরা ‘ওয়াক আউট’ করতে শুরু করেন। আচমকা বিরোধীদের বেরিয়ে যেতে দেখে ক্ষোভ জানাতে শুরু করেন সরকার পক্ষের সদস্যেরা। মন্ত্রী চন্দ্রিমা উঠে দাঁড়িয়ে বলতে থাকেন, ‘‘বক্তৃতা করলেন, প্রশ্ন করলেন আর জবাব শুনলেন না!’’ এই হট্টগোলের মধ্যে বিজেপির অন্য সদস্যেরা বেরিয়ে গেলেও নিজের আসনে বসে ছিলেন অশোক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিরোধী দলের সচেতক শঙ্কর ঘোষ ফিরে এসে তাঁকে উঠে আসতে বলেন। তার পরে অশোকও বেরিয়ে যান। তাতেই ক্ষুব্ধ পরিষদীয় মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, অরূপ বিশ্বাসেরা একযোগে বিজেপির বিরুদ্ধে শাস্তির দাবি জানাতে থাকেন। অরূপ বলেন, ‘‘যাঁদের জবাব শোনার সাহস নেই, তাঁদের বক্তব্য থাকাও উচিত নয়। আমরা তা নথি থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।’’
এর পরেই বিরোধীদের ভূমিকার নিন্দা করে স্পিকার এই আলোচনা থেকে বিজেপি সদস্যদের বক্তব্য বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানান। ফলে, তাঁদের তোলা প্রশ্নের জবাবও দেননি মন্ত্রী চন্দ্রিমা। একেবারে নিয়ম রক্ষায় বিল পাশ হয়েছে। এই আইন কার্যকর হলে ঝুলে থাকা বিক্রয়কর সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তি সহজ বলে দাবি করেছে সরকার পক্ষ। ধার্য সুদ ও তার জন্য বরাদ্দ শাস্তির ক্ষেত্রে ছাড় পাবেন করদাতা। সেই সঙ্গে বকেয়ার ৭৫%-এই গোটাটা মিটিয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকবে তাঁদের।
বিধানসভার কার্যবিবরণী থেকে বিরোধীদের বক্তব্য বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তে কড়া প্রতিক্রিয়াই জানিয়েছে বিজেপি। বিরোধী দলের সচেতক শঙ্করের বক্তব্য, ‘‘আলোচনার সময়ে অশোক লাহিড়ী পেঁয়াজের খোসা ছড়ানোর মতো করে তৃণমূল সরকারের অর্থনীতির খোসা ছাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেই বক্তব্য কার্যবিবরণীতে থেকে গেলে তৃণমূলের কাছে লজ্জার হতো। লজ্জার হাত থেকে বাঁচতেই স্পিকার এই রুলিং দিয়েছেন!’’
বিরোধীদের ‘কণ্ঠরোধে’র অভিযোগে বিতর্ক এখানেই থামছে না। অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির (ওবিসি) তালিকা নিয়ে বিধানসভায় বলেছিসেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার প্রেক্ষিতে বিধানসভার কার্যবিধির ৩১৯ ধারায় আলোচনার জন্য প্রস্তাব আনতে চেয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। পরিষদীয় সূত্রের খবর, বিধানসভার সচিব এ দিন সন্ধ্যায় বিরোধী দলনেতাকে চিঠির জবাব দিয়ে জানিয়েছেন, ওবিসি বিষয়টি ‘বিচারাধীন’ বলে স্পিকার আলোচনার অনুমতি দিচ্ছেন না। বিরোধী শিবিরের প্রশ্ন, ওবিসি-প্রশ্নে অনেক দিন ধরেই আদালতে মামলা চলছে। তা হলে ‘বিচারাধীন’ অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রী ওবিসি নিয়ে কথা বললেন কী করে!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)