Advertisement
E-Paper

সিন্ডিকেটের দাপটে বন্ধ কাগজকলের কাজ

সিঙ্গাপুর থেকে লগ্নি আহ্বান করে সপার্ষদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে দিন কলকাতায় ফিরলেন, সে দিনই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে বন্ধ হয়ে গেল আরও একটি কারখানার কাজ। যে রাজ্যে রাজনৈতিক সুস্থিতি ও সুরক্ষা আছে, তাদের শিল্পপতিরা সেখানেই বিনিয়োগ করবেন বলে ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করে দিয়েছে সিঙ্গাপুর।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৪ ০৩:৫৮

সিঙ্গাপুর থেকে লগ্নি আহ্বান করে সপার্ষদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে দিন কলকাতায় ফিরলেন, সে দিনই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে বন্ধ হয়ে গেল আরও একটি কারখানার কাজ।

যে রাজ্যে রাজনৈতিক সুস্থিতি ও সুরক্ষা আছে, তাদের শিল্পপতিরা সেখানেই বিনিয়োগ করবেন বলে ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করে দিয়েছে সিঙ্গাপুর। কিন্তু রাজ্যে একের পর এক শিল্পসংস্থায় দাদাগিরি এবং অশান্তির ঘটনা এবং তাতে শাসক দলের লোকজনের জড়িত থাকার অভিযোগ এড়ানো যাচ্ছে না।

শুক্রবার দুর্গাপুরের প্রতাপপুরে যে কাগজকলে ‘সাসপেনশন অব ওয়ার্ক’ নোটিস ঝোলানো হয়, তারা সিন্ডিকেটের চাপ সহ্য করতে না পেরেই নির্মাণকাজ বন্ধ করেছে বলে অভিযোগ। সেটির মালিক, দিল্লির শিল্পপতি বাবু খান্ডেলওয়াল দুর্গাপুর ছাড়ার আগে আক্ষেপ করে গিয়েছেন, “এখানে শিল্পের উপযুক্ত পরিবেশ নেই। তাই কাজ বন্ধ করতে হল।”

ঘটনাচক্রে, যে সিঙ্গাপুরে মুখ্যমন্ত্রী বিনিয়োগ আনতে গিয়েছিলেন, সেখানকারই আবাসন সংস্থা কেপেল ল্যান্ড লিমিটেডও সিন্ডিকেটের দাপটে রাজারহাটে আবাসন প্রকল্পের কাজ অসম্পূর্ণ রেখে পাততাড়ি গুটিয়েছে বলে অভিযোগ। লাভজনক শিল্পের পরিবেশ না থাকাও তাদের রাজ্য ছাড়ার অন্যতম কারণ বলে সংস্থা সূত্রের খবর। রাজ্যে তথ্যপ্রযুক্তি পার্ক গড়ার প্রকল্প তারা আগেই বাতিল করে দিয়েছিল।

দুর্গাপুরে কেন ঝাঁপ ফেলতে হল কাগজকলের কাজে?

খান্ডেলওয়ালের অভিযোগ, “সিন্ডিকেট ও লোক নিয়োগ নিয়ে তৃণমূলের দুটি গোষ্ঠীর দাপটে চরম সমস্যা দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি না বদলালে কারখানা আর চালু হবে কি না, বলা মুশকিল।” গত মঙ্গলবারই বর্ধমান জেলা পরিষদের সভাধিপতি তথা তৃণমূল নেতা দেবু টুডুর সঙ্গে দেখা করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সংস্থার কর্তারা অভিযোগ করেছিলেন, সিন্ডিকেটের দাপটে তাঁদের কারখানা লাটে ওঠার জোগাড়। তার তিন দিনের মধ্যে দুর্গাপুরের প্রতাপপুর এলাকায় ওই কাগজকলে আপাতত নির্মাণকাজ বন্ধ হওয়ায় সেই আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হল।

ঘটনাচক্রে, বৃহস্পতিবারই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মধ্যাহ্নভোজ খাওয়ানোর পরে সিঙ্গাপুরের বিদেশ ও আইনমন্ত্রী কে ষণ্মুগম জানিয়েছেন, তাঁর দেশের শিল্পপতিরা সেই রাজ্যেই বিনিয়োগ করতে চাইবেন, যেখানে রাজনৈতিক সুস্থিতি ও সুরক্ষা আছে। যেখানে বিনিয়োগ করতে তাঁরা ভয় পাবেন না। অর্থাৎ, মুখ্যমন্ত্রী সদলবলে সিঙ্গাপুরে গেলেও আদৌ লগ্নি আনতে পারবেন কি না, তার অনেকটাই এই ‘শিল্পবান্ধব পরিবেশ’ দিতে পারা বা না পারার উপরে নির্ভর করছে।

অথচ রাজারহাট-নিউটাউন থেকে দুর্গাপুর, যেখানেই সিন্ডিকেট গড়ে দাদাগিরি-গুন্ডামির অভিযোগ উঠছে, কোথাওই তৃণমূলের লোকজনের নাম অভিযোগের বাইরে থাকছে না। তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব যতই এ নিয়ে সতর্ক করুন, এমনকী উত্তর ২৪ পরগনায় লিখিত নির্দেশ দিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত হতে নিষেধ করুন, তাতে যে লাভ বিশেষ হচ্ছে না তা কার্যত পরিষ্কার। পরিস্থিতি এতটাই সঙ্গিন যে দলের নেতা সিন্ডিকেটে জড়িত বলে রাজ্য নেতৃত্ব তথা পুলিশের কাছে কিছু দিন আগেই লিখিত অভিযোগ করেছিলেন আসানসোল-দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদের (এডিডিএ) চেয়ারম্যান তথা স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়। তাতেও ছবিটা পাল্টায়নি।

একের পর এক এই ধরনের ঘটনা রাজ্যের বাইরে কী বার্তা নিয়ে যাচ্ছে, তা-ও দিল্লির শিল্পপতির বক্তব্যে পরিষ্কার। রাতে দিল্লি ফেরার আগে বাবু খান্ডেলওয়াল বলে যান, “যা পরিবেশ দাঁড়িয়েছে, কাজ চালানো যাবে না। তাই নোটিস দিতে হল।” সিটুর বর্ধমান জেলা সভাপতি বিনয়েন্দ্রকিশোর চক্রবর্তীও দাবি করেন, “তৃণমূলের দু’টি গোষ্ঠীর কার আধিপত্য বজায় থাকবে, তা নিয়ে গণ্ডগোলের জেরেই কাগজকলটি বন্ধ হয়েছে বলেই আমরা খবর পেয়েছি।”

তৃণমূল নেতাকর্মীদের একাংশও কার্যত একই কথা কবুল করছেন। দলের দুর্গাপুর-ফরিদপুর ব্লক সভাপতি সুজিত মুখোপাধ্যায় বলেন, “তাপস

মণ্ডল ও মানস মণ্ডল নামে দুই স্থানীয় তৃণমূল নেতা ওখানে সিন্ডিকেট চালাচ্ছেন বলে আমরা অভিযোগ পেয়েছি। জড়িতদের বিরুদ্ধে দলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিওয়েছি।”

স্থানীয় সূত্রের খবর, বছর চারেক আগে প্রতাপপুরে একটি কাগজকল খোলা হলেও তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেটি কিনে নিয়ে ফের উৎপাদন চালুর তোড়জোড় শুরু করেছে বর্তমান সংস্থাটি। কারখানার ম্যানেজার অর্ধেন্দু হাজরা জানান, অসীম ঘোষ নামে এক শিল্পপতি কারখানাটি গড়েছিলেন। বিভিন্ন কারণে সেটি চালাতে পারেননি। অনাদায়ী ঋণ থাকায় ব্যাঙ্ক কারখানাটি বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিল। গত জুনে ব্যাঙ্কের থেকে প্রায় পৌনে তিন কোটি টাকায় তা কেনেন বাবু খান্ডেলওয়াল। সীমানা পাঁচিল ও অন্য কিছু নির্মাণকাজ বাকি ছিল। উৎপাদন বাড়াতে কিছু সম্প্রসারণ প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়।

এই গোটা নির্মাণকাজের দায়িত্বে রয়েছেন মনোতোষ সেন চৌধুরী নামে এক ঠিকাদার। তাঁর অভিযোগ, “সিন্ডিকেটের প্রবল চাপে যা দাম তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা দিয়ে নির্মাণসামগ্রী কিনতে হয়েছে। তার পরে শুরু হয়েছে লোক নেওয়ার চাপ।” যত মজুর প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক বেশি মজুর নিতে বাধ্য করা হয় বলেও অভিযোগ। তবে সিন্ডিকেটের সঙ্গে কোন রাজনৈতিক দলের লোক জড়িত, তা তিনি খোলসা করেননি। তাঁর আক্ষেপ, “বাধ্য হয়ে কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে। নির্মাণসামগ্রী নষ্ট হচ্ছে।”

এর পরেও অবশ্য ঠিকাদার কোথাও অভিযোগ জানাননি। কেন? মনোতোষবাবু পাল্টা বলেন, “কোথায় অভিযোগ জানাব? আমি কর্তৃপক্ষকে সব বলেছি। জানিয়ে দিয়েছি, আমার পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়।” অর্ধেন্দুবাবু বলেন, “পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে আমি মালিককে খবর দিই। উনি কারখানায় আসেন। বৈঠক হয়।” তাঁর অভিযোগ, তৃণমূলের নেতৃত্বে এ দিন এলাকার কিছু লোকজন কারখানার সামনে এসে জড়ো হয়ে কাজের দাবি করতে থাকেন। পরিস্থিতি দেখে কাজ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

বিকেলে কারখানার গেটে নোটিস দিয়ে জানানো হয়, ‘বিভিন্ন প্রকার অশান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার দরুণ আমরা কারখানার যে কোনও কাজকর্ম বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছি।’ অর্ধেন্দুবাবু বলেন, “উৎপাদন শুরু হলে সব অদক্ষ শ্রমিকই স্থানীয় ভাবে নেওয়া হবে বলে ঠিক হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, যাতে এলাকার আর্থিক উন্নয়ন হয়। কিন্তু তার আগেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হল।”

রাত পর্যন্ত অবশ্য তাপস মণ্ডল বা মানিক মণ্ডলের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। আইএনটিটিইউসি-র জেলা সভাপতি প্রভাত চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, বিষয়টি তাঁর জানা নেই।

paper mill locked out durgapur
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy