Advertisement
E-Paper

ওদের কথাও শুনুন, সময় দিন

বাড়ি থেকে পালানোর এমন ঘটনা নতুন নয়। মঙ্গলবার দিনের শেষে হাওড়ার ওই দুই খুদেকে বাড়ি ফেরানো গেলেও সবাই অবশ্য ফেরে না।

সম্রাট মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৭ ০৩:৫২
প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

পথ হারায়নি ওরা। কেউ কোনও টোপ দিয়েও নিয়ে যায়নি। রীতিমতো পরিকল্পনা করেই স্কুলের গেট থেকে পালিয়ে গিয়েছিল দু’টি শিশু। এক জনের বয়স দশ। অন্য জনের আট। দু’জনেই বেলুড়ের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের পড়ুয়া।

বাড়ি থেকে পালানোর এমন ঘটনা নতুন নয়। মঙ্গলবার দিনের শেষে হাওড়ার ওই দুই খুদেকে বাড়ি ফেরানো গেলেও সবাই অবশ্য ফেরে না। কিন্তু সব কিছু ছেড়ে এ ভাবে পালিয়ে যাওয়া কীসের টানে? স্রেফ অ্যাডভেঞ্চারের দুর্নিবার নেশা, না কি অন্য কোনও আকর্ষণ?

এক কালে এ ধরনের ‘দুঃসাহসী’ অভিযানের পরে উপসংহারটি অবধারিত ভাবেই রচিত হত লাঠ্যৌষধির ভাষায়। সে যুগ আর নেই। আধুনিক মনোবিজ্ঞান শিখিয়েছে, শারীরিক নিগ্রহের শাস্তিতে লাভের থেকে ক্ষতির আশঙ্কা অনেক বেশি। শুধু তা-ই নয়, মৌখিক শাসনেও সংযত হওয়া উচিত বাবা-মায়েদের। মনে আঘাত দিয়ে নয়, বরং বুঝিয়ে বলাটাই শ্রেয়। তবেই তা কার্যকর হয়। শিক্ষাবিদ থেকে সমাজতাত্ত্বিক— প্রত্যেকেই এখন এই মতের শরিক। অভিভাবকদের পাশাপাশি স্কুলের শিক্ষকেরাও দিনে দিনে এই সংযমের শিক্ষাতেই অভ্যস্ত হয়েছেন। শাসনের বাড়াবাড়ি এড়িয়ে চলেন তাঁরাও। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, ছোটদের এ ধরনের আচরণ আটকাতে কী করণীয়? এ সব ক্ষেত্রে কি চিরকেলে সেই চোখরাঙানিই কার্যকর? না কি অন্য কোনও ভাবে এর মোকাবিলা সম্ভব?

ভালবাসার উপরেই ভরসা রাখতে চান সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র। তাঁর কথায়, ‘‘সন্তানকে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দেওয়া, উপহারে ভরিয়ে রাখাটাই কিন্তু তাকে ভালবাসা নয়। প্রকৃত ভালবাসাটা ওরা ঠিকই বুঝতে পারে। সেখানেই হয়তো খামতি থেকে যাচ্ছে। যে কোনও সম্পর্কই কিন্তু টিকে থাকে ভালবাসার জোরে। সেই ভিতটা শক্ত না-হলে মুশকিল।’’

ভালবাসার এই অভাববোধ থেকেই শিশুরা মুক্তি পেতে চায়। তা থেকেই হয়তো জন্ম নেয় পালিয়ে যাওয়ার অবাধ্য প্রবণতা। অভিজিৎবাবু মনে করিয়ে দিচ্ছেন, বাচ্চাদের উপরে আজকাল অনেক চাপ। পড়াশোনার চাপ তো আছেই। সঙ্গে সব কিছুতে শ্রেষ্ঠ হওয়ার প্রত্যাশা। তিনি বলেন, ‘‘নিজেদের গণ্ডিতে আজকাল বড় আবদ্ধ ছোটরা। কে জানে, হয়তো স্বাধীনতা খুঁজে নিতেই ওরা এ ভাবে বেরিয়ে পড়ে। কোথায় যাবে, কোথায় থাকবে, কী খাবে— কিচ্ছুটি না ভেবেই। কিন্তু সেটা যে অনুচিত ও বিপজ্জনক, তা ওদের বোঝানো দরকার। সে ক্ষেত্রে শাসন করলেও দেখতে হবে, তাতে যেন শিশুটির সম্মানহানি না হয়। বরং সে যেন ভুল বুঝে নিজেকে শুধরে নেয়।’’

শিশুদের মান-অপমান বোধের বিষয়টি উঠে এসেছে শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকারের ভাবনাতেও। তাঁর মতে, ‘‘স্পেয়ার দ্য রড অ্যান্ড স্পয়েল দ্য চাইল্ড— এখন তো আর এই আপ্তবাক্য খাটে না। সে সব আমাদের ছেলেবেলায় হত। এ যুগে বাবা-মায়েদের একেবারে পড়াশোনা করার মতো করে শিখতে হবে, কী ভাবে শাসন করা উচিত, যাতে কাজও হয় আবার ছেলেমেয়েরা অপমানিতও বোধ না করে।’’ কিন্তু সেই আদর্শ শাসন-পদ্ধতি শেখা যাবে কী ভাবে? পবিত্রবাবু বলেন, ‘‘আমার জানা নেই। মনোবিদ বা সমাজতাত্ত্বিকেরা হয়তো এ বিষয়ে পথ দেখাতে পারবেন।’’

সন্তানকে শাসন করা মানেই কি তাকে বকুনি দেওয়া বা ভয় দেখানো? মানতে নারাজ মনোরোগের চিকিৎসক জ্যোতির্ময় সমাজদার। তাঁর মতে, ‘‘বাবা-মায়েরা একটা কথা ভুলে যান যে, বলার থেকে শোনাটা অনেক বেশি জরুরি। ছোটদের উপদেশ দেওয়া খুব সহজ। কিন্তু একটু ধৈর্য ধরে ওদের কথা শোনাটা অনেক বেশি কঠিন। সেই শোনার অভ্যাসটা বড়দের তৈরি করতে হবে।’’ এ সব ক্ষেত্রে বকুনির থেকে গল্পের ছলে কথা বলাটাই অনেক বেশি কার্যকর বলে মত জ্যোতির্ময়বাবুর। তাঁর কথায়, ‘‘কেউ হয়তো ভাবল, সে শাহরুখ খানের বাড়ি যাবে। কিন্তু সেটা যে সম্ভব নয়, তা তো তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে। আর তার জন্য ঠান্ডা মাথায় তার কথাটা শুনতে হবে। বাবা-মায়েরা বাচ্চাদের কথা শুনতে চান না বলেই একটা দূরত্ব তৈরি হয়, যার থেকে এমন প্রবণতা দেখা দিতে পারে।’’

কথা শোনার এই অভ্যাসের সঙ্গে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সময় কাটানোটাও জরুরি বলে মনে করেন দক্ষিণ কলকাতার একটি স্কুলের ডিরেক্টর ও শিক্ষিকা দেবী কর। তাঁর মতে, ‘‘প্রতিটি শিশুর মতো প্রতিটি ঘটনাও কিন্তু আলাদা। তাই সবার সমস্যাকে এক ছাঁচে ফেলা যায় না। আপনজনদের মধ্যে থেকেও কিন্তু অনেক সময়ে একাকিত্ব গ্রাস করে ছোটদের। তার কারণ, বাবা-মা হয়তো সন্তানের জন্য সময় বার করতে পারেন না। সেটাও সমস্যা তৈরি করে।’’

এ ক্ষেত্রে স্কুলের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ? দেবী কর বলেন, ‘‘স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দায়িত্ব তো আছেই। আমরা ওদের পরিস্থিতি বুঝে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করি। তবে, বাবা-মায়ের দায়িত্ব আরও বেশি।’’

Child Depression অবসাদ
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy