Advertisement
E-Paper

ভোগান্তির মুখে দিশাহারা রোগীদের পরিজন

মায়ের ব্রঙ্কোস্কোপি করাবেন বলে গত মঙ্গলবারই লিলুয়ার রেলওয়ে কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক থেকে নগদ ১৫ হাজার টাকা তুলেছিলেন পুষ্পা খালকো। পুরোটাই পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট। আর ওইদিন সন্ধ্যাতেই প্রধানমন্ত্রীর ঐতিহাসিক ঘোষণা।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৪০
হাতে পাঁচশো-হাজার টাকার নোট। এসএসকেএমে ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকানে।

হাতে পাঁচশো-হাজার টাকার নোট। এসএসকেএমে ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকানে।

মায়ের ব্রঙ্কোস্কোপি করাবেন বলে গত মঙ্গলবারই লিলুয়ার রেলওয়ে কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক থেকে নগদ ১৫ হাজার টাকা তুলেছিলেন পুষ্পা খালকো। পুরোটাই পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট। আর ওইদিন সন্ধ্যাতেই প্রধানমন্ত্রীর ঐতিহাসিক ঘোষণা। রাত বারোটার পর থেকে ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট আর চলবে না। পুষ্পা চিন্তায় সারারাত ঘুমোতে পারেননি।

পুষ্পা আর তাঁর মা সুকুরা আদতে সাঁওতাল। সুকুরা সামান্য কাজ করেন লিলুয়া রেলওয়ে ওয়ার্কশপে। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সঞ্চয় অতি সামান্য। ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড নেই, নেই এটিএম কার্ডও। উপায়ান্তর না দেখে ওই টাকা নিয়েই বুধবার সকালে বাইপাসের ধারে নামী বেসরকারি হাসপাতালে চলে এসেছিলেন দু’জনে। তাঁদের দিশেহারা অবস্থা দেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য বিনা পয়সাতেই ব্রঙ্কোস্কোপি করেছে। শুধু একটি ‘ক্রেডিট ডিল’-এ সুকুরাদের সই করানো হয়েছে, যাতে বলা হয়েছে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে তাঁদের টাকা দিয়ে যেতে হবে।

হাসপাতাল থেকে ছুটি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বাড়ি ফিরতে পারেননি অনুপম দত্ত। মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার এই বাসিন্দা ভর্তি ছিলেন ইএম বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালে। পায়ে একটি অস্ত্রোপচার হয়েছে তাঁর। সব মিলিয়ে বিল হয়েছে ১ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা। কিন্তু তাঁর ছেলের ক্রেডিট কার্ডের ঊর্ধ্বসীমা দেড় লক্ষ টাকা। ঠিক ছিল কার্ড আর নগদ মিলিয়ে বিল মেটাবেন। নগদ টাকা আছে, কিন্তু প্রায় সবই হাজার টাকার নোট। এটিএম কার্ড আছে। কিন্তু ব্যাঙ্ক বন্ধ থাকায় টাকা তুলতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত তাই ছুটি হওয়া সত্ত্বেও হাসপাতালেই থেকে যেতে হয়েছে অনুপমবাবুকে। বৃহস্পতিবার বেলডাঙা থেকে তাঁর এক প্রতিবেশী এসে কার্ডে বাকি টাকা মিটিয়ে তাঁর বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করবেন।

হাসপাতালে নিখরচায় পরীক্ষা করিয়ে গেলেন সুকুরা খালকো।

একই অবস্থা অন্য এক হাসপাতালে ভর্তি ৮৭ বছরের অমলেন্দু দত্তগুপ্তের। শ্বাসকষ্টের রোগী অমলেন্দুবাবুর বাড়ি ফেরার কথা ছিল বুধবার। সেই মতো মঙ্গলবারই ব্যাঙ্ক থেকে কয়েক লক্ষ টাকা তোলেন পরিবারের সদস্যরা। সবটাই ৫০০ ও ১০০০ টাকা। এটিএম ও ব্যাঙ্ক বন্ধ থাকায় বুধবার নতুন করে টাকা তুলতে পারেননি। ফলে অমলেন্দুবাবুর ডিসচার্জ একদিন পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।

অনুপমবাবু বা অমলেন্দুবাবুই শুধু নন, ভোগান্তির এমন নজির এ দিন বহু বেসরকারি হাসপাতালেই দেখা গিয়েছে। আউটডোরের টিকিট করানো নিয়ে সমস্যা। পরীক্ষানিরীক্ষার খরচ মেটাতে সমস্যা। এমনকী ভর্তি থাকা রোগীদের ছুটি হয়ে যাওয়ার পর বাড়ি ফিরতেও সমস্যা।

এ দিন সকালে বাইপাসের একাধিক বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল, চারপাশে বিভ্রান্ত মানুষের ভিড়। ভিন্ রাজ্য থেকে চিকিৎসা করাতে এসেছেন যাঁরা, তাঁরা অথৈ জলে পড়েছেন। একই অবস্থা বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান থেকে আসা রোগীদের। যেমন গত ৮ নভেম্বর সড়কপথে বাংলাদেশের চাঁদপুরের হাজিগঞ্জ থেকে এসেছেন আবুল বসার মিঞা। পূর্ব যাদবপুর এলাকার এক হাসপাতালে তিনি চিকিৎসার জন্য এসেছেন। ডলার ভাঙিয়ে যেটুকু ভারতীয় টাকা সঙ্গে এনেছেন তার বেশিরভাগই পাঁচশো আর হাজারে। শুকিয়ে যাওয়া মুখচোখ নিয়ে জানালেন, আউটডোরে ৭০০ টাকা খুচরো দেওয়ার পর সঙ্গে আর কোনও একশো টাকার নোট নেই। ফলে সকাল থেকে খাবার কিনতে পারেননি। যে বাড়িতে দৈনিক ৬০০ টাকা ভাড়ায় রয়েছেন সেখানেও ভাড়া দিতে পারেননি। বলেন, ‘‘এমন যে হইবে কল্পনাও করিনি।’’

সকাল দশটা। একটি হাসপাতালের ঠিক উল্টো দিকের দোকান থেকে খালি হাতে ফিরে এলেন দুই মণিপুরী তরুণী। নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কেনার জন্য ৫০০ টাকার নোট দিয়েছিলেন। দোকানি তা নিতে নারাজ। ওই দুই তরুণীর দিদি কলকাতার ওই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন দু’দিন আগে। নিজেরা কাছেই একটি গেস্ট-হাউসে রয়েছেন। চিকিৎসা ও থাকা-খাওয়ার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। সেই টাকার অধিকাংশই রয়েছে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটে।

মণিপুরের লাগোয়া রাজ্য ত্রিপুরা থেকে এসেছেন সোনালি ও রঞ্জন দেববর্মা। এক মাত্র সন্তানের চিকিৎসার জন্য কলকাতায় এসেছেন দিন সাতেক আগে। ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাজার থেকে তুলে নেওয়ার খবর অনেক দেরিতে জানতে পেরেছেন। এখন মাথায় হাত তাঁদের।

ছাড়া পেলেন না অমলেন্দু দত্তগুপ্ত।

বুধবার ছবিগুলি তুলেছেন বিশ্বনাথ বণিক ও পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়।

মানুষের ভোগান্তির সুযোগ নিয়ে এরই মধ্যে কোনও কোনও জায়গায় শুরু হয়ে গিয়েছে ব্যবসা। বাইপাসের একটি বেসরকারি হাসপাতালের বাইরে ১০০০ টাকা দিলে ৮০০ টাকা দেওয়ার কারবার শুরু করেছেন কেউ কেউ।

এরই মধ্যে কিছু কিছু জায়গায় সামান্য স্বস্তির ছবি। মুকুন্দপুরের একটি হাসপাতাল রোগী ভর্তি বা রোগীর ছুটির সময়ে এ দিন ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট নিয়েছে ঠিকই। কিন্তু ভোটার কার্ড বা আধার কার্ডের কপি, সঙ্গে একটি বন্ড লিখিয়ে নিচ্ছে। একই পথ নিয়েছে পার্ক সার্কাসের একটি বেসরকারি শিশু হাসপাতাল। আলিপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতাল রীতিমতো বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়েছে, শুক্রবার পর্যন্ত তারা ৫০০ ও ১০০০ টাকার পুরনো নোটই নেবে। রাজারহাটের একটি ক্যানসার হাসপাতাল আউটডোরে আসা রোগীদের ভিজিটের ক্ষেত্রেও কিছু ছাড় দিয়েছে। ভিজিটের ৭০০ টাকার পুরোটা যাঁরা খুচরো টাকায় দিতে পারেননি, তাঁদের ‘ডিউ স্লিপে’ সই করিয়ে নিয়ে পরিষেবা দেওয়া হয়েছে।

ওষুধের দোকানগুলিতে আবার বুধবার সকাল থেকে নানারকম বিভ্রান্তির সূত্রপাত। ‘বেঙ্গল কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস অ্যাসোসিয়েশন’-এর ছাতার তলায় রাজ্যের ৪০ হাজার ওষুধের দোকান রয়েছে। সংগঠনের সভাপতি শঙ্খ রায়চৌধুরী জানান, প্রথম দিকে সকলের মনেই একটা ধারণা হয়েছিল যে, সরকারি-বেসরকারি সব ওষুধের দোকানেই ৫০০ ও ১০০০-এর নোট নেওয়া হবে। বেলা বাড়তেই সেই ধারণা ভাঙে। ততক্ষণে প্রায় সব দোকানই ক্রেতাদের থেকে ৫০০-১০০০ এর নোট নিয়ে ফেলেছে। তারা বিভ্রান্ত হয়ে ফোন করতে থাকে। ক্রেতারা আবার পড়েন অন্য সমস্যায়। অনেকেই কয়েক হাজার টাকার ওষুধ কিনতে এসে খুচরো দিতে না পেরে ৫০০ বা ১০০০ এর নোট নেওয়ার জন্য কাকুতিমিনতি করতে থাকেন।

এ দিন সরকারি হাসপাতাল চত্বরে পিপিপি মডেলে চলা ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকানগুলি শুধু সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের ওষুধের ক্ষেত্রে পাঁচশো ও হাজার টাকা নিয়েছে। বাকিদের খুচরো টাকাতেই ওষুধ কিনতে হয়েছে।

City hospital Patient
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy