কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় স্থলসীমান্ত চুক্তি বিল অনুমোদন হতেই নাগরিকত্বহীনতার যন্ত্রণা ঘোচার দিন গোনা শুরু হল ছিটমহলের বাসিন্দাদের। মঙ্গলবার সংবাদমাধ্যমে ওই বিল অনুমোদনের খবর চাউর হতেই ছিটমহল বিনিময় কবে হতে পারে সে ব্যাপারে বাসিন্দাদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। মশালডাঙা থেকে শিবপ্রসাদমুস্তাফি প্রায় সব ছিটমহল জুড়েই ছিল ওই এক ছবি। সেইসঙ্গে জাতি-ধর্ম নিবির্শেষে ‘ওপরওয়ালা’র কাছে দ্রুত ওই স্বপ্নপূরণের দিনভর প্রার্থনায় মাতেন বাসিন্দারা। মশালডাঙার তরুণ জয়নাল আবেদিন, সাদ্দাম হোসেন থেকে প্রবীণ বাসিন্দা বেলাল হোসেন, নওসদ আলি মত অনেকেই ‘ছিটমহাল বিনিময় সমন্বয় কমিটি’র পতাকা নিয়ে মসজিদে যান। আবার ওই ছিটমহলের বাসিন্দা বাদল দাস, ভারতী দাসদের মত অনেকে মন্দিরে গিয়ে পুজো দেন।
‘ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহাল বিনিময় সমন্বয় কমিটি’ অবশ্য আগাম উচ্ছ্বাসে মাততে চাইছেন না। ফলে দীর্ঘদিনের স্বপ্নপূরণের দোড়গোড়ায় এসেও রঙিন আবিরে অকাল হোলি কিংবা মিষ্টি বিলিতে মাতেননি কেউ। ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন, “ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়। ছিটমহলের বাসিন্দাদের অবস্থাও তেমনই। কেন্দ্রে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের সময়েও এমন বিল অনুমোদন হয়েছিল। কিন্তু আখেরে ছিটমহল বিনিময় হয়নি। তাই এ বার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা স্থলসীমান্ত চুক্তি বিলে অনুমোদন দিলেও নিশ্চিত হতে পারছেন না সেখানকার বাসিন্দারা।’’ তিনি জানান, সবাই এখন সংসদে ওই বিল পাশ হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির সইয়ের অপেক্ষায় দিন গুনছেন। প্রার্থনাও করেছেন। যে দিন ওই বিলে রাষ্ট্রপতি সই করবেন, সে দিন ১৬২টি ছিটমহলে নজরকাড়া উৎসব হবে। বুধবারই সংসদে পাশ হতে চলেছে বিলটি।
মন্দিরে প্রার্থনা।
সমন্বয় কমিটি সূত্রে জানা গিয়েছে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একাধিক বার সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। কিন্তু ছিটমহলের বাসিন্দাদের দুর্দশা ঘোচেনি। এমনকী ২০১৩ সালে প্রথম বার দুই দেশের ঠিকানা বদলে আগ্রহীদের তালিকা করা হয়। ফলে ভারতের ১১১টি ও ও বাংলাদেশের ৫১টি মিলিয়ে মোট ১৬২টি ছিটমহলের ৫১,৪৮৪ জন বাসিন্দা দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছেন। তাঁদের কোনও দেশের নাগরিকত্ব নেই। সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র, আধার কার্ড কিংবা রেশন কার্ড নেই। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানীয় জল, বিদ্যুৎ পরিষেবা নেই। নেই যোগাযোগের রাস্তাঘাটও।
এই অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে অবশ্য ইতিমধ্যে কৃতিত্ব দাবির প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। তৃণমূলের কোচবিহার জেলা সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, “ছিটমহল বিনিময় নিয়ে শুরু থেকে উদ্যোগী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দুদেশের ছিটমহলে জনগণনা, বাংলাদেশ সফর, কেন্দ্রের ওপর চাপ বাড়ান, ছিটলাগোয়া এলাকায় সভা করার মত নানা দায়িত্ব তিনি নিজে একক ভাবে সামলেছেন। তাই পুরো কৃতিত্ব মুখ্যমন্ত্রীর।” কোচবিহারের জেলা কংগ্রেস সভাপতি শ্যামল চৌধুরী বলেন, “মনমোহন সিংহের আমলে ওই চুক্তি হয়েছে। ছিটমহল বিনিময়ের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। মমতা বন্দোপাধ্যায় আপত্তি করায় বিষয়টি এত দিল আটকে ছিল।” বিজেপির কোচবিহার জেলা সভাপতি হেমচন্দ্র বর্মন বলেন, “ছিটমহল বিনিময় নিয়ে যা কাজের কাজ হয়েছে তা কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের সময়। তাই ওই কাজের পুরো কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর মন্ত্রিসভার।” আবার বামেরাও বলছেন, কৃতিত্ব তাঁদের। সিপিএমের কোচবিহার জেলা সম্পাদক তারিণী রায় বলেন, “আগাগোড়া বামেরা ওই ব্যাপারে সরব ছিলেন। তৃণমূল, বিজেপিই বরং এক সময় বিরোধিতা করেছিল। সীমান্ত চুক্তি বিল সংসদে পাশ হলে খুশি হব।” ফরওয়ার্ড ব্লকের কোচবিহার জেলা সম্পাদক উদয়ন গুহের কটাক্ষ, “ছিটমহল বিনিময় আমাদের পুরানো দাবি। সংসদে ওই বিল গৃহীত হয় কি না সেটাই এখন দেখার।”
মঙ্গলবার হিমাংশুরঞ্জন দেবের তোলা ছবি।