এ দিন মাদুরদহে জরিপ শুরু হতেই স্থানীয় বাসিন্দারা সরকারি কর্মী ও পুলিশের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়েন। পুরোভাগে ছিলেন মহিলারা। তর্ক ক্রমশ ধস্তাধস্তির চেহারা নেয়। পোঁতা খুঁটি উপড়ে ফেলা হয়। আধ ঘণ্টা অশান্তির শেষে সরকারপক্ষ পিছিয়ে আসে। ‘জবরদস্তি জমি দখলের’ প্রতিবাদে পুলিশি ব্যারিকেডের সামনে অবস্থান-বিক্ষোভে বসে প্রমীলা বাহিনী। ওঠে সিঙ্গুর প্রসঙ্গও। যদিও প্রশাসন ও শাসকদলের একাংশের মতে, সিঙ্গুর-কাণ্ডের সঙ্গে একে কোনও ভাবেই গুলিয়ে ফেলা যায় না। ‘‘ওটা ছিল চাষির রুজি-রুটির প্রশ্ন। আর এটা স্রেফ জবরদখল।’’— মন্তব্য এক আধিকারিকের।
কী বলছেন জমির বাসিন্দারা?
রাস্তার ধারে ফাঁকা জায়গা দেখে অনেক দিন আগেই ওখানে ডেরা বেঁধেছেন জীবন মল্লিক। তিনি বলেন, জমির এক ধারে রয়েছে বেশ কিছু ঝুপড়ি বস্তি। অন্য দিকে যাঁদের বাস, তাঁরা ১৯৮৭-তে সালে ওই জমিতে ‘বর্গাদার’ হিসেবে নথিভুক্ত হয়েছেন বলে দাবি। জীবনবাবু তাঁদেরই এক জন। ওঁদের কথায়, ‘‘এখন কর্পোরেশন এসে বলছে, জমি ঘিরব! আমরা সকলে হাতে-হাত মিলিয়ে প্রতিবাদে নেমেছি।’’ প্রতিবাদকারীদের দাবি, তাঁদের থাকার ব্যবস্থা না-করে জমি ঘেরা যাবে না।
জীবনবাবুদের ‘বর্গা দাবি’ প্রসঙ্গে বাম আমলের ভূমিমন্ত্রী তথা তৃণমূল সরকারের বর্তমান মন্ত্রী আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার যুক্তি— অপারেশন বর্গার সময় কেউ কেউ বর্গাদারের সার্টিফিকেট পেয়েছিলেন। কিন্তু ওঁদের বলা হয়েছিল ভূমি দফতরের অফিসে গিয়ে পরচা (রেকর্ড অফ রেজিস্ট্রেশন, সংক্ষেপে আরআর) করিয়ে নিতে। ‘‘সেটা যাঁরা করিয়েছেন, মালিক হিসেবে শুধু তাঁরাই গণ্য হবেন। অন্যেরা নয়।’’— মন্তব্য রেজ্জাকের। বামফ্রন্ট সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণ, ‘‘সব রেকর্ডই প্রশাসনের কাছে থাকার কথা। না-থাকলে জমির মালিকানা নিয়ে সংশয় হতে পারে।’’
জেলা ভূমি দফতরের খবর: মাদুরদহে ওই তল্লাটের মোট ১৪৫ একর এক সময়ে ছিল দু’ভাইয়ের নামে— প্রতিভারঞ্জন রায় ও প্রণবপ্রসাদ রায়। পরে তা ভাগ হয়ে যায়। রাজ্যের আবাসনমন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য— ১৯৬৮-র পরে জমিটি খাস ঘোষিত হয়। ১৯৮৮-তেও তা খাসই ছিল। অতএব ওখানে ১৯৮৭-র নথিভুক্ত বর্গাদার হিসেবে নিজেদের দাবি করাটা ঠিক নয়। জেলা প্রশাসনের কাছেও এমন কোনও রেকর্ড নেই।
তবে আশ্বাসবাণীও শুনিয়েছেন মেয়র। ‘‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীতি, কাউকে উচ্ছেদ করা হবে না। তাই জমি ঘেরার সময়ে দেখা হবে, কেউ যেন বাস্তুচ্যুত না হন।’’— বলেছেন তিনি। আর প্রশাসনের কাজে বাধাদান প্রসঙ্গে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘এ সব করে কিছু হবে না। সব কিছুর পদ্ধতি রয়েছে। এটাকে সিঙ্গুরের সঙ্গে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ঠিক নয়।’’
উদ্ভুত পরিস্থিতির নেপথ্যে ‘স্বার্থান্বেষী চক্রের’ প্ররোচনাও দেখতে পাচ্ছেন শোভনবাবু। অন্য দিকে যাঁরা নিজেদের জমির ‘মালিক’ হিসেবে দাবি করছেন, ঘটনাপ্রবাহে তাঁরা যারপরনাই ক্ষুব্ধ। এঁদেরই এক জন হলেন পঞ্চসায়রের মনোজ চক্রবর্তী। তিনি বলছেন, ‘‘প্রণবপ্রসাদ রায়ের ভাগের জমি আমি কিনেছিলাম। তখন জানতাম না, ওটা মৎস্য দফতরের আওতায়। পরে জেনেছি।’’ মনোজবাবুর সাফ কথা, ‘‘জমি সত্যিই খাস হয়ে থাকলে সরকার নিয়ে নিক। বর্গাদারের কথা আসছে কোত্থেকে?’’ পাশাপাশি প্রতিভারঞ্জন রায়ের বংশধর উদয়শঙ্কর রায়ের অভিযোগ, ‘‘কোনও নোটিস ছাড়াই আমাদের জমি সরকার দখল করেছিল। আমরা মামলা করি। তা এখনও বিচারাধীন। তবু সরকার জমি ঘেরার চেষ্টা করছে!’’
প্রশাসন অবশ্য অনড়। মেয়র পরিষ্কার জানিয়েছেন, জমিটি খাস। এবং সে সংক্রান্ত তথ্য প্রশাসনের কাছে আছে। তাই জমি ঘেরা হবেই।
তবে সে ক্ষেত্রে বাসিন্দাদের ভবিষ্যৎ মাথায় রাখার প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন মেয়র।