সে তাণ্ডব এখনও ভুলতে পারেন না ওঁরা। ২০২০ সালের ২০ মে। ঘূর্ণিঝড় আমপানের। উপকূলে আছড়ে পড়ার সময় ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৫৫ থেকে ১৬৫ কিলোমিটার। দুই ২৪ পরগনার উপকূল এলাকায় বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। চোট পেয়েছিল পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূল এলাকাও। সে ক্ষত এখনও রয়ে গিয়েছে দুই ২৪ পরগনা এবং পূর্ব মেদিনীপুরের ভুক্তভোগীদের জীবনে। দুই ২৪ পরগনায় দুশ্চিন্তা আমপানে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের হাল নিয়ে। পূর্ব মেদিনীপুর উপকূলে ক্ষোভ, ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ট্রলার, ভুটভুটির জন্য ক্ষতিপূরণ না মেলায়।
‘‘পাঁচ বছর আগের সে দিনটা ছিল আতঙ্কের। বিকেল ৩টে নাগাদ, আকাশ কালো হয়ে গেল। সোঁ-সোঁ করে বওয়া হাওয়ার ঝটকায় গাছ উপড়ে দোকানের পাশে পড়ছিল। বিদ্যুতের তারও ছিঁড়ে পড়ল। সন্ধ্যার আগেই অন্ধকার,’’ স্মৃতিতে ভাসে পূর্ব মেদিনীপুরের রামনগরের বাসিন্দা রতন শী-র। উত্তর ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জের ধরমবেড়িয়া গ্রামের কমলা মণ্ডল বলেন, ‘‘আমপানের রাতে বাঁধ ছাপিয়ে হু-হু করে গ্রামে জল ঢুকতে শুরু করে। সারা রাত বাঁধের উপরে বসেছিলাম।’’ তাঁর ক্ষোভ, ‘‘পরে জোড়াতালি দিয়ে সংস্কার হলেও, এখনও বেহাল এলাকার বাঁধ। এ ভাবে কতদিন চলবে, জানি না!’’
দক্ষিণ ২৪ পরগনার নামখানার মৌসুনি দ্বীপের বালিয়াড়া এলাকাতেও নদীবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। এলাকাবাসীর ক্ষোভ, মেরামত হলেও এখনও ‘বেহাল’ সেইবাঁধ। ঘোড়ামারা দ্বীপে চুনপুড়ি, হাটখোলা নদীর বাঁধের দশা শোচনীয়। একই ছবি গোসাবার কালীদাসপুর, পুঁইজালি, ছোট মোল্লাখালি, তারানগর, রাঙাবেলিয়া, কুমিরমারী এলাকায় কাপুরা, রায়মঙ্গল, সারসা, বিদ্যা ও গোমর নদীর বাঁধের। পাঁচ বছরে মাটির নদীবাঁধ অস্থায়ী মেরামত করেছে প্রশাসন। কিন্তু স্থায়ী সমাধান অধরা রয়েছে। ঘোড়ামারা দ্বীপের বাসিন্দা সুকদেব দাস বলেন, “আমপানে বাঁধের প্রচুর ক্ষতি হয়েছিল। জমি-বাড়ি ভেসে যায়। এখনও বহু বাঁধ বেহাল। বাঁধের স্থায়ী ব্যবস্থা না করলে, দ্বীপ রক্ষা করা যাবে না।” আমপানে প্রচুর গাছের ক্ষতি হয়। পরবর্তী কালে প্রশাসনের তরফে কোথাও কোথাও গাছ বসিয়ে ক্ষতিপূরণের চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু অভিযোগ, পর্যাপ্ত গাছ না বসানোয় সে ক্ষতিও পূরণ হয়নি।
যদিও সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী বঙ্কিম হাজরা বলেন, “আমপানে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামত করে উঠতে না উঠতেই ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে আরও বেশি ক্ষতি হয়। রাজ্য সরকার বার বার মেরামত করছে। কিছু জায়গায় কংক্রিটের বাঁধ হয়েছে, কিছু কাজ চলছে। কেন্দ্রীয় বরাদ্দ না আসায় বহু এলাকায় কংক্রিটের বাঁধ তৈরি করা যাচ্ছে না।”
পূর্ব মেদিনীপুরের শঙ্করপুর এবং তাজপুরেও আমপানের দাপটে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সে বাঁধ এবং তার উপরের রাস্তা এখন ঝাঁ চকচকে। পাঁচ বছর আগে দুর্যোগের সে পর্বে দিঘা-রামনগর এলাকায় চার দিন বিদ্যুৎ ছিল না। এখন অবশ্য দিঘায় মাটির তলায় বিদ্যুতের কেব্ল পাতা হয়েছে। খেজুরি-২ ব্লকের পাচুড়িয়া, ওয়াসিলচক এলাকায় রসুলপুর নদীবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছিল এলাকা। সেচ দফতরের উদ্যোগে সেখানে বেশ কিছুটা অংশে কংক্রিটের বাঁধ হয়েছে। তবে কয়েকশো ভুটভুটি এবং ট্রলার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তার সরকারি ক্ষতিপূরণ এখনও মেলেনি বলে মৎস্যজীবী মহল ক্ষুব্ধ। পূর্ব মেদিনীপুর মৎস্যজীবী ফোরামের সম্পাদক দেবাশিস শ্যামল বলেন, ‘‘প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তেরা ছবি-সহ আবেদন করেছিলেন। কিন্তু টাকা পাননি।’’ জেলা সভাধিপতি উত্তম বারিকের অবশ্য দাবি, ‘‘আমপানের পরে, ইয়াসেও ক্ষতি হয়েছিল জেলার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্য সরকারের সহযোগিতায় জেলার ক্ষতিগ্রস্তেরা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)