শরীর-স্বাস্থ্য এমনিতেই আর ভাল যায় না আজকাল। মনটা যে ভাল রাখব, সে উপায়ও আর থাকছে না। মাথার উপর থেকে স্নেহের হাতগুলো একটার পর একটা সরে যাচ্ছে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর চলে যাওয়াটা কী ভাবে মেনে নেব, বুঝতে পারছি না।
আমার এখন আশি বছর বয়স। এই বয়সে এসেও মাথার উপরে গুরুজনরা থাকবেন, স্নেহের হাত রাখবেন, এটা আশা করাই কঠিন। তবু তো ছিলেন, এই বয়স পর্যন্তও আমার গুরুজন হিসেবে তাঁকে তো পাচ্ছিলাম। আর তো পাব না— কষ্টটা কী রকম, কী ভাবে আর বলি।
নীরেনদার সঙ্গে আমার পরিচয় যখন হয়েছিল, তখন আমি খুব ছোট, কৈশোরে। আমার বাবা-মায়ের সূত্রে আলাপ। কিন্তু প্রথম আলাপেই তাঁকে খুব ভাল লেগে গিয়েছিল। সেই থেকেই নীরেনদার বৃত্তে পাকাপাকি ভাবে থেকে গিয়েছিলাম। সেই বৃত্তটাই আজ আর রইল না। নীরেনদা আমার বাবার বয়সী ছিলেন না, আমার থেকে ১৪-১৫ বছরের বড় ছিলেন। কিন্তু নীরেনদা আমার বাবার আমলের মানুষ ছিলেন। সত্যি বলতে কি, নীরেনদার কাছ থেকে পিতৃস্নেহটাই পেতাম। তাই যখন শুনলাম, নীরেনদা আর নেই, আমি নিতে পারিনি। নীরেনদার যে অনেক বয়স হয়েছে, শরীর যে ভাল যাচ্ছে না, সে সবই তো জানতাম। কিন্তু স্নেহের আশ্রয়টার চলে যাওয়া মানতে পারছি না কিছুতেই।
আরও পড়ুন: রোদ্দুর হয়ে গেলেন অমলকান্তির কবি নীরেন্দ্রনাথ
নিজের অসুস্থতার কারণে শেষ কিছু দিন নীরেনদার কাছে আমি যেতে পারিনি। কিন্তু ফোনে কথা হত। নীরেনদার সাম্প্রতিক লেখালিখিও সব পড়তাম। ক’সপ্তাহ আগেই ওঁর একটা লেখা পড়লাম একটা লিটল ম্যাগাজিনে। সে লেখায় কোথাও বয়সের ছাপ নেই। আসলে উনি নিজেই নিজের বয়স হতে দেননি।
আরও পড়ুন: এক এক করে সিনিয়াররা চলে যাচ্ছেন…
দেশ পত্রিকার জন্য প্রথম বার যখন আমার লেখা নির্বাচিত হল, তখন আমার কাছে যে চিঠিটা এসেছিল, তাতে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর স্বাক্ষর। উনি চিঠি লিখে জানিয়েছেন যে, আমার লেখা দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হবে। সে দিনের অনুভূতি তো আজও টাটকা। আমাকে ছোটদের জন্য লেখার উৎসাহ নীরেনদাই জুগিয়েছিলেন। এই বয়সে এসেও আমার লেখা কোথাও বেরোলেই নীরেনদা পড়তেন। পড়ে তাঁর মতামত জানাতেন, বলতেন ভাল লেগেছে, উৎসাহ দিতেন। যে প্রশ্রয় নীরেনদার কাছ থেকে সারা জীবন পেয়েছি, তার কোনও সীমা-পরিসীমা নেই।
আরও পড়ুন: ‘কাঁধে হাত রেখে ওই নিরুচ্চার হাসির দাম মেটাতে পারবে না কবিতাও’
আমার জীবনের একটা পর্বে খুব মন খারাপের মধ্যে পড়েছিলাম। অনেক দিন আগের কথা। পাশে বসে নীরেনদা বলেছিলেন, ‘সত্যেরে লও সহজে’। পুরো কবিতাটা শুনিয়েছিলেন সে দিন। এ ভাবেই ভাল সময়, খারাপ সময়, সব সময়েই নীরেনদা আগলে আগলে রেখেছিলেন যেন। এখন আর কে আগলাবেন!
আরও পড়ুন: ‘সিগারেট-চা দিয়ে বসিয়ে আমাকে তালাবন্ধ করে চলে গিয়েছিলেন’
আরও পড়ুন: এ বার কিছু আটকালে আর কার কাছে যাব?
চিরদিন তো কেউই থাকবেন না। যেতে তো সকলকেই হবে। তবু মন মানে না। আমার জীবনের এত কিছু নীরেনদার সঙ্গে জড়িয়ে যে, এই সত্যটাকে সহজে নেওয়া খুব কঠিন। তবে কবি নীরেন্দনাথ চক্রবর্তীর তো আর মৃত্যু নেই। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আমাদের কাছে চিরকালই থাকবেন, তাঁকে নিয়েই আমরা থাকব।
(বাংলার রাজনীতি, বাংলার শিক্ষা, বাংলার অর্থনীতি, বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার স্বাস্থ্য, বাংলার আবহাওয়া -পশ্চিমবঙ্গের সব টাটকা খবর আমাদের রাজ্য বিভাগে।)