Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
দখল-যুদ্ধের প্রত্যাবর্তন

তিন জন খুন হলো, দাঁড়িয়ে দেখল পুলিশ

বাম জমানায় ছিল কেশপুর-নন্দীগ্রাম। তৃণমূলের শাসনে পাড়ুই! ছবি সেই একই। গ্রাম জুড়ে সশস্ত্র দুষ্কৃতীদের তাণ্ডব। বোমার ধোঁয়ায় ঢাকা চারপাশ। মাস্কেট থেকে মুহূর্মুহূ গুলি। রক্তাক্ত লাশ আর শয়ে শয়ে আতঙ্কিত মুখ। লড়াইয়ের নেপথ্যে এলাকা দখল-পুনর্দখলের রাজনীতি। পাড়ুইয়ের মাখড়া গ্রামে সোমবার যা হল, বা গত কয়েক দিন ধরে যা হচ্ছে, তা সেই রাজনীতিরই অনিবার্য পরিণাম। লোকসভা ভোটে এ রাজ্যে বিজেপির উত্থানের পরে এই প্রথম এত বড় আকারে তাদের সঙ্গে সংঘর্ষ হলো শাসক দলের।

নিহত তৃণমূল কর্মী শেখ মোজাম্মেল (সবুজ গেঞ্জি) ও তাঁর আহত ভাই শেখ এনামুল। তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

নিহত তৃণমূল কর্মী শেখ মোজাম্মেল (সবুজ গেঞ্জি) ও তাঁর আহত ভাই শেখ এনামুল। তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

মহেন্দ্র জেনা ও দয়াল সেনগুপ্ত
পাড়ুই ও সিউড়ি শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:০৯
Share: Save:

বাম জমানায় ছিল কেশপুর-নন্দীগ্রাম। তৃণমূলের শাসনে পাড়ুই!

ছবি সেই একই। গ্রাম জুড়ে সশস্ত্র দুষ্কৃতীদের তাণ্ডব। বোমার ধোঁয়ায় ঢাকা চারপাশ। মাস্কেট থেকে মুহূর্মুহূ গুলি। রক্তাক্ত লাশ আর শয়ে শয়ে আতঙ্কিত মুখ।

লড়াইয়ের নেপথ্যে এলাকা দখল-পুনর্দখলের রাজনীতি। পাড়ুইয়ের মাখড়া গ্রামে সোমবার যা হল, বা গত কয়েক দিন ধরে যা হচ্ছে, তা সেই রাজনীতিরই অনিবার্য পরিণাম। লোকসভা ভোটে এ রাজ্যে বিজেপির উত্থানের পরে এই প্রথম এত বড় আকারে তাদের সঙ্গে সংঘর্ষ হলো শাসক দলের। ১৪৪ ধারা জারি থাকা সত্ত্বেও পুলিশের চোখের সামনে সেই সংঘর্ষে প্রাণ হারালেন তিন জন। এক জন বিজেপির। দু’জন তৃণমূলের।

স্থানীয় সূত্রের খবর, তৃণমূলের নিরঙ্কুশ আধিপত্য থাকা ইলামবাজার এবং পাড়ুইয়ের বিভিন্ন গ্রামে লোকসভা ভোটের কিছু আগে থেকেই উত্থান হয়েছে বিজেপির। যার জেরে এই এলাকা ক্রমশই হাতছাড়া হয়েছে তৃণমূলের। এ দিন মাখড়ায় বহিরাগত বাহিনী এনে জমি পুনর্দখল করতে চেয়েছিল তারা। বিজেপি বাধা দিয়েছে। সব মিলিয়ে ২০০৭ সালে নন্দীগ্রামে ‘অপারশন সূর্যোদয়’-এর প্রতিচ্ছবি। বিজেপি রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের অভিযোগ, “নন্দীগ্রামের মতো এখানেও যৌথ বাহিনীর (শাসক দল এবং পুলিশ) হামলা হয়েছে।”

গ্রামবাসীদের দাবি, এ দিন সকাল থেকেই সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ওই গ্রামে তাণ্ডব চালায় তৃণমূল-আশ্রিত দুষ্কৃতী দল। বহিরাগত শ’দেড়েক দুষ্কৃতী হাতে মাস্কেট, বোমা, ভোজালি, দোনলা বন্দুক, পাইপগান, লাঠি, টাঙ্গি নিয়ে দাপিয়ে বেড়ায় গোটা গ্রাম। বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের বাড়িতে ভাঙচুর করে, লুঠপাট চালায়। বিয়েবাড়ি তছনছ করে দেয়। শেখ তৌসিফ আলি নামে ১৯ বছরের এক তরুণের পেট ফুঁড়ে দেয় ওই দুষ্কৃতীদের গুলি। বিনা চিকিৎসায় সে পড়ে থাকে গ্রামের ভিতরে। দুষ্কৃতী-দাপটে তাকে কেউ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাননি। ঘণ্টাদেড়েক বাদে গাড়ি করে বিজেপি সমর্থক পরিবারের ওই তরুণকে যখন সিউড়ি সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, তত ক্ষণে সে মারা গিয়েছে।

অভিযোগ, গোটা ঘটনাটা গ্রামের বাইরে দাঁড়িয়ে দেখেছে পুলিশ, র‌্যাফ আর কমব্যাট ফোর্স। হামলা থামাবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেনি। অথচ, রবিবারই ওই এলাকায় গিয়েছিলেন রাজ্য পুলিশের আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) সিদ্ধিনাথ গুপ্ত।

বাড়ির দেওয়ালে বোমার দাগ। সোমবার মাখড়া গ্রামে বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরীর তোলা ছবি।

স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, তৃণমূলের হামলার প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে পাল্টা হামলা চালান গ্রামের বিজেপি কর্মী-সমর্থকেরাও। দু’পক্ষের মধ্যে ব্যাপক বোমাবাজি শুরু হয়। ঘণ্টা তিনেক পরে বোমাবাজি থামতে পুলিশবাহিনী গ্রামে ঢুকে তিন তৃণমূল কর্মীকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে। শেখ সোলেমান (৪৫) এবং শেখ মোজাম্মেল (৪০) নামে দুই তৃণমূলকর্মী পরে মারা যান সিউড়ি হাসপাতালে। সোলেমানের বুকে গুলি লেগেছিল। আর মোজ্জামেলকে পিটিয়ে মারা হয়। পেটে গুলি খেয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন লাল বাস্কি ও শেখ এনামুল নামে আরও দুই তৃণমূলকর্মী। এনামুল ও মোজাম্মেল দুই ভাই এবং তাঁরা মাখড়া গ্রামেরই বাসিন্দা। লাল বাস্কির বাড়ি দুবরাজপুর থানার কলুষিতা গ্রামে। সোলেমান দুবরাজপুরের সালুঞ্চি গ্রামের বাসিন্দা।

এ দিন হাসপাতাল চত্বরে দাঁড়িয়ে জেলা তৃণমূলের সহ-সভাপতি মলয় মুখোপাধ্যায় দাবি করেছেন, তৌসিফ বাদে নিহত ও আহতেরা তাঁদের দলেরই কর্মী। তৌসিফের দিদি তনজিনা বিবি হাসপাতাল চত্বরে দাঁড়িয়ে বলেন, “আমার ভাই রাস্তায় ঢালাইয়ের কাজ করছিল। তৃণমূলের বাইক-বাহিনী গ্রামে ঢুকে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে। একটা গুলি ভাইয়ের পাঁজরের নীচে বিঁধে যায়।”

মাখড়া লাগোয়া চৌমণ্ডলপুরে গত শুক্রবার বোমা উদ্ধার করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন পাড়ুই থানার ওসি। সোমবার সকালে সেখানে যাওয়ার কথা ছিল জেলা বিজেপির প্রতিনিধি দলের। তাদের আটকাতেই তৃণমূলের চাপে পুলিশ-প্রশাসন রবিবার রাতারাতি ইলামবাজার ব্লকের মঙ্গলডিহি ও বাতিকার এই দু’টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে বলে বিজেপি-র অভিযোগ। মাখড়া গ্রামটি মঙ্গলডিহি পঞ্চায়েতের অন্তর্গত।

১৪৪ ধারা থাকা সত্ত্বেও কী ভাবে এত বড় দুষ্কৃতী দল মাখড়ায় ঢুকে পড়ল? কেন পুলিশ গ্রামের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল? এই সব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি জেলা ও রাজ্যের পুলিশকর্তাদের কাছে। ডিআইজি (বর্ধমান রেঞ্জ) ত্রিপুরারি বলেন, “আমি এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করব না। পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলুন।” পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া ফোন ধরেননি। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনন্দ রায়-ও মন্তব্য করেননি। মন্তব্য করেননি আইজি (আইনশৃঙ্খলা) অনুজ শর্মাও।

বীরভূম জেলা বিজেপি-র সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষের দাবি, তিনি এ দিন সকালেই খবর পান, ইলামবাজার ব্লক তৃণমূল সভাপতি তথা বীরভূম জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ জাফারুল ইসলামের নেতৃত্বে সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা শাল নদী পেরিয়ে কানপুর গ্রাম হয়ে মাখড়ায় ঢুকবে। এ রাজ্যে বিজেপির প্রথম ‘রাজনৈতিক শহিদ’, ইলামবাজারের কানুর গ্রামের বাসিন্দা শেখ রহিম খুনে মূল অভিযুক্ত এই জাফারুলই। দিলীপবাবু বলেন, “আমি সঙ্গে সঙ্গে সে কথা বোলপুরের এসডিপিও সূর্যপ্রতাপ যাদব এবং পাড়ুইয়ের সিআই-কে জানাই। তবু পুলিশ কিছু করল না!”

সকাল ১০টা নাগাদ কিছু পুলিশকর্মী মাখড়া গ্রামে পুরুষদের ধরপাকড় শুরু করে। হাবুল মিস্টার ও শেখ প্রহ্লাদ নামে নিরীহ দুই গ্রামবাসীকে আটক করা হয় বলে অভিযোগ। এর পর বেলা ১১টা নাগাদ শাল নদী পেরিয়ে তৃণমূলের দুষ্কৃতী বাহিনী প্রথমে হামলা চালায় মাখড়ার দক্ষিণপাড়ায়। ওই পাড়ার বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের অভিযোগ, হামলার নেতৃত্বে ছিলেন জাফারুলই। ও দিকে, জনা পঞ্চাশেকের মোটরবাইক বাহিনী দু’দলে ভাগ হয়ে জাহানাবাদ-মোল্লাপাড়ার দিক থেকে গ্রামে ঢোকে। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, এলোপাথাড়ি বোমা ছুড়তে ছুড়তে দুষ্কৃতীরা প্রথমেই বিজেপি সমর্থক শেখ জিয়া আলির বাড়িতে হামলা চালায়। তিনি বাড়িতে ছিলেন না। তাঁর বাড়িতে ভাঙচুর, লুঠপাট চালানোর পরে দুষ্কৃতীরা পাশের বাড়িগুলিতে ভাঙচুর করতেও শুরু করে। এমনকী মারধরের হাত থেকে রেহাই পাননি মহিলারাও। বিজেপি সমর্থক পরিবারের মেয়েদের, এমনকী এক অন্তঃসত্ত্বারও শ্লীলতাহানি করা হয় বলে অভিযোগ। গ্রামের একাধিক তরুণী এ দিন বলেন, “তৃণমূলের গুন্ডাবাহিনী আমাদের মাথায় বন্দুক ধরে। ভোজালি দেখায়। রেপ করার হুমকি দেয়!”

হামলার কয়েক ঘণ্টা পরেও আতঙ্ক যায়নি বাসিন্দাদের। এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা শেখ আসগর আলি, শেখ আক্কেল আলির কথায়, “এত বয়স হয়ে গেল। আমাদের এলাকায় এমন গুন্ডামি আর লুঠতরাজ জীবনে কখনও দেখিনি! তৃণমূলের গুন্ডারা মুহূর্তের মধ্যে গোটা গ্রাম তছনছ করে দেয়। পুলিশ প্রথম দিকে গ্রামে ছিল। তবু হাত গুটিয়ে বসে রইল।” আক্রান্ত পরিবারের মহিলারা জানালেন, গুলি চলা শুরু হতেই পুলিশ গ্রাম ছেড়ে কেটে পড়ে।

দক্ষিণপাড়াতেই আজ, মঙ্গলবার বিয়ে হওয়ার কথা শেখ সুজলের। সেই উপলক্ষে বাড়িতে আত্মীয়েরা এসেছিলেন। প্যান্ডেল খাটানো হয়ে গিয়েছিল। রান্নার তোড়জোড় চলছিল। সুজলের ভাই শেখ উজ্জ্বল বলেন, “আগে তৃণমূল করতাম। এখন গ্রাম বাঁচাতে বিজেপি করি। সেই রাগেই তৃণমূলের বাহিনী আমাদের বাড়িতে হামলা করে। প্যান্ডেল ছিঁড়ে ফেলে বাড়িতে লুঠপাটে চালায়। মেয়েদের শাড়ি ধরে টানাটানি করে। বাড়ির একটা ছোট মেয়ের শ্লীলতাহানিও করে।” উজ্জ্বলদের পাশেই শেখ তৌসিফের বাড়ি। নিহত এই তরুণের বাবা, গ্রামের বিজেপি কর্মী শওকত আলি বলেন, “ছেলে রাস্তার কাজ করতে গিয়েছিল। তৃণমূল গুলি করে ওকে মেরে দিল! ওর তো কোনও দোষ নেই!”

তত ক্ষণে মোটরবাইক বাহিনী গ্রামে ঢুকে হামলা শুরু করেছে। উত্তরপাড়া, পশ্চিমপাড়া, মোড়লপাড়ায় মুড়ি-মুড়কির মতো বোমা পড়তে শুরু করেছে। সেই ধাক্কা সামলে ধীরে ধীরে প্রতিরোধ শুরু করেন এলাকার বিজেপি কর্মী-সমর্থকেরাও। অভিযোগ, তাঁরাও পাল্টা বোমা মারতে শুরু করেন তৃণমূলের বাহিনীকে লক্ষ্য করে। নিজের বাড়িতেই পিটিয়ে মারা হয় স্থানীয় তৃণমূল কর্মী মোজাম্মেলকে। তাঁর দাদা এনামুলকেও বেধড়ক পেটানো হয়। গ্রামের মসজিদ লাগোয়া জমিতে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা এনামুল যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে বলেন, “তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে আমি ওই দলে আছি। বিজেপির সন্ত্রাসে অনেক দিন গ্রামছাড়া ছিলাম। এ দিনই গ্রামে ফিরি। তার পরেই বিজেপি হামলা চালায়।” কিছু পরেই দক্ষিণপাড়ায় গুলি করে মারা হয় তৃণমূলকর্মী সোলেমানকে। পাল্টা হামলার মুখে পড়ে পিছু হটে তৃণমূলের বাহিনী।

বিজেপির বীরভূম জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডল এ দিন অভিযোগ করেন, “দুবরাজপুর, ইলামবাজার থেকে শ’য়ে শ’য়ে দুষ্কৃতী ভাড়া করে মাখড়া গ্রাম দখলের ছক কষেছিল তৃণমূল। অনুব্রত মণ্ডল নিজে ইলামবাজারের পার্টি অফিসে বসে গোটা অপারেশন পরিচালনা করেছেন।”

তার জবাবে এ দিন জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল বলেছেন, “কিছু হার্মাদ সিপিএম ছেড়ে বিজেপি-তে গিয়েছে। তারাই এ দিন হামলা চালিয়ে আমাদের কর্মীদের মেরেছে।”

যা শুনে দুধকুমারের প্রতিক্রিয়া, “সশস্ত্র হামলা ঠেকাতে গ্রামবাসীরাই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ করেছেন। আর তাতেই হয়তো এ দিন তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা মারা গিয়েছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE