বছর চারেক আগে মাদক মামলায় জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে সে থাকত সন্ন্যাসীর বেশে। পরনে সাদা ফতুয়া, সাদা ধুতি, কপালে চন্দনের তিলক। বছরে এক বার করে গ্রামের বাড়িতে নাম-সংকীর্তনের আসর বসাত। অনেকে ভেবেছিলেন, সংশোধনাগারে গিয়ে বুঝি তার ধর্মে মতি হয়েছে। তবে গত মাস ছয়েক কেউ তাঁকে এলাকায় দেখেননি। নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জের বাসিন্দা সেই সুশান্ত ঘোষ ওরফে ‘লাল’ই বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা এলাকায় ‘বাঙ্কার’ গড়ে কাশির নিষিদ্ধ সিরাপ মজুত করা চক্রের পান্ডা বলে মনে করছে পুলিশ।
পুলিশের দাবি, এলাকার বাইরে থেকে পাচার-চক্র পরিচালনা করছিল লাল। গত জুলাইয়ে বাংলাদেশ অশান্ত হওয়ার পরে, নদিয়ারই ভীমপুরে ২০ হাজার বোতল সিরাপ পাচার হওয়ার সময়ে ধরা পড়ে। তার পর থেকে সে বেপাত্তা। সোমবার কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার সুপার অমরনাথ কে বলেন, “প্রাথমিক ভাবে আমরা জানতে পারছি যে, ওই সব বাঙ্কার লালই তৈরি করেছিল। সিরাপের বোতল সে-ই পাচারের জন্য মজুত করেছিল।”
কৃষ্ণগঞ্জের মাজদিয়ায় যেখানে ওই সব ভূগর্ভস্থ কুঠুরি করা হয়েছিল, সেখান থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে। ২৪ জানুয়ারি ৩টি বাঙ্কারে মজুত করা ৬২ হাজারেরও বেশি কাশির নিষিদ্ধ সিরাপের বোতল ‘আবিষ্কার’ করে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। একটি নির্মীয়মাণ বাঙ্কারেরও হদিস মিলেছে। বিএসএফ ইতিমধ্যেই ‘নার্কোটিকস কন্ট্রোল ব্যুরো’র (এনসিবি) হাতে তদন্তভার তুলে দিয়েছে। রবিবার এনসিবি-র আধিকারিকেরা কৃষ্ণগঞ্জের নাঘাটা কলেজপাড়ার ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রতিটি ‘বাঙ্কার’-এর মাপ নেন, বেশ কিছু নমুনাও সংগ্রহ করেন। সোমবার এনসিবি ও বিএসএফের পক্ষ থেকে উদ্ধার হওয়া ৬২,২০০ বোতল সিরাপ কৃষ্ণনগর আদালতে হাজির করা হয়।
পুলিশ সূত্রের দাবি, এ পর্যন্ত যে চারটি ‘বাঙ্কার’ বা ভূগর্ভস্থ কুঠুরির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, তার একটি লালের জমিতেই। মাজদিয়া কলেজের কাছেই যেখানে জুয়ার ঠেক বসত, সেখানে সেই কুঠুরি লুকোনো ছিল। সেখান থেকে বড় জোর দুশো মিটারের মধ্যে লালের বাড়ি। সোমবার তার মা মায়া ঘোষ দাবি করেন, “ওই জমি লালের নয়, শরিকি জমি। বাঙ্কারও লাল বানায়নি। তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা হচ্ছে।” লাল নিরুদ্দেশ এবং বছরখানেক বাড়ির সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই বলেও তাঁর দাবি।
কৃষ্ণনগর জেলা পুলিশের দাবি, বিএসএফের তরফে এনসিবি-কে তদন্তভার দেওয়া হলেও, তারা নিজেদের মতো খোঁজখবর শুরু করেছে। যে চারটি জমিতে ভূগর্ভস্থ কুঠুরি করা হয়েছিল, সেগুলির মালিকের নাম এ দিনই কৃষ্ণগঞ্জ ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে। লাল ছাড়া, তার যে আত্মীয় ওই শরিকি জমির মালিক, শুক্রবারের পরে সে-ও এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে।
পুলিশ সূত্রের খবর, পূর্ব বর্ধমানের ভাতার থানাতেও তার নামে মাদক পাচারের মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। তবে কলকাতা হাই কোর্ট থেকে জামিন পেয়েছিল লাল। এর পরে মাঝেসাঝে তাকে দেখা গেলেও, ধরা যায়নি। পুলিশ সুপার বলেন, “গত জুলাইয়ে ভীমপুর থানা যে ২০ হাজার কাশির সিরাপের বোতল ধরেছিল, সে ঘটনায় লাল জড়িত ছিল। সেই থেকে তার খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছি। ফলে, ও এলাকায় ঢুকতে পারেনি বলেই হয়তো মজুত বোতলগুলি পাচার করতে পারেনি।” বোতলগুলি বছর খানেকের পুরনো, দাবি পুলিশের। ইতিমধ্যেই পাচারে জড়িত সন্দেহে এলাকার কয়েক জনকে কৃষ্ণগঞ্জ থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে।
সীমান্তের এত কাছের এলাকাটি পুলিশ ছাড়া সরাসরি বিএসএফের নজরদারিতেও থাকার কথা। বিএসএফের ডিআইজি তথা দক্ষিণ সীমান্তের মুখপাত্র নীলোৎপলকুমার পাণ্ডেকে ফোন করা হলে তিনি প্রথমে জানান, মিটিংয়ে ব্যস্ত আছেন। পরে আর ফোন ধরেননি। মোবাইল-বার্তার জবাবও মেলেনি।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)